করিমা দুই ফোঁটা উষ্ণ আঁখিজল আঁচল দিয়া মুছিয়া কহিলেন–“ভাই, আমেনার জন্য প্রাণ আমার চুর্ণ হয়ে গিয়েছে! বল কী করতে পারি?”
রায়হান বলিলেন–“বন্ধুর কথা, বিশ্বাস ও সহানুভূতিতে মানুষের বহু দুঃখ কমে বটে। আমি ইচ্ছা করি, আজ হতে ভালো করে আমরা তার ভার গ্রহণ করি। সব সময়ে তাকে আনন্দ দেই–জীবন তার সরস ও সুখময় হোক।”
করিমা বলিলেন–“নিজের সঙ্গে সঙ্গে রাখবার উপায় নাই, তোমারও একই অবস্থা। অন্তত সকাল বিকালে তার সঙ্গে যেয়ে মিশতে হবে–আমাদের উদ্দেশ্য কী, সে কথা তার এবং সবার কাছে থেকে গোপন থাকবে।”
করিমা হাসিয়া বলিলেন–“আমেনাকে যদি আমাদের বাড়িতে আনি তাতে কী ক্ষতি?”
“না, তা তার পক্ষে খুবই মর্মান্তিক হবে লোকের চোখেও ভালো দেখাবে না।”
করিমা কহিলেন–“তা ঠিক।”
রায়হান কহিলেন–“বুবু, আর একটা কথা–তুমি কারো কাছে আমেনাকে নিয়ে কোনো কথা বলো না। যার যাই ইচ্ছে তাই বলুক, আমেনার হয়ে কারো কাছে কোনো কথা বলবার দরকার নাই।”
করিমা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন–“আমারও তাই ইচ্ছে।”
রায়হান কহিলেন–“চাচিকে বলে যদি তাকে দিনের বেলায় স্কুলে যোগ দেওয়াতে পারি, তার চেষ্টা করব।”
করিমা বলিলেন–“কাজে মানুষের অনেক দুঃখ-কষ্ট ঘুচে যায়। দিনের বেলায় তাকে যদি সঙ্গে পাই তা হলে খুব ভালোই হয়। আমার বেহারাদের বলে দিলে তারা আমেনাকে আনা-নেওয়া করবে। তাতে বেশি খরচ হবে না।”
রায়হান বলিলেন–“ভালো যুক্তি, এতে তার কোনো আপত্তি থাকতে পারে না।”
.
চত্বারিংশ পরিচ্ছেদ
বড় চৌচালা একখানা ঘর-মেঝে সান বাঁধা।–এই ঘরে মেয়েরা কাজ করেন। পড়িবার একটা স্বতন্ত্র কামরা আছে। বেলা দুইটা হইতে সেইখানে পড়া আরম্ভ হয়। সে সময় অন্য সব কাজ বন্ধ থাকে।
হেডমিস্ট্রেস কিরণবালার বাসা স্কুলঘর হইতে একটু দূরে–স্কুল-কম্পাউন্ডেরই ভিতর। সম্মুখে মিস্ত্রী-শিক্ষকের বাসা। তিনিও পরিবার লইয়া থাকেন, তিনি ব্রাহ্মণ।
কিরণবালার স্বামী, সখাওত হোসেন, মিস্ত্রী এবং রায়হান ছাড়া কারও স্কুলে প্রবেশ অধিকার নাই।
মেয়েদের বোর্ডিং-ঘর, দুই শিক্ষকের দুইবাসা এবং স্কুল ঘেরিয়া প্রাচীর; ভিতরের দিকে প্রাচীরের গায়ে গায়ে ফুল ও লতা-পাতা উপরে লৌহশিক বসান। গেট বন্ধ করিয়া দিলে কোনো বিপদের সম্ভাবনা থাকে না।
প্রস্তুত জিনিসপত্র সবই রায়হান গ্রহণ করেন–তিনিই বিক্রয় করেন। লাভ ছাড়া প্রত্যেক জিনিসে নির্দিষ্ট দাম বসাইয়া হিসাব করিয়া মোট যে মূল্য হয় তাহা শিল্পবিদ্যালয়ের ফান্ডে জমা দেওয়া হয়। ফলে রায়হানেরও প্রচুর লাভ হইতেছে। স্কুলেরও একটা বাঁধা মাসিক আয় হইয়াছে।
দর্জির কাজ যে সব ছাত্র শিখিয়াছেন তাহাদের মধ্যে সকলের চেয়ে ভালো হইয়াছেন আবুল কাসেম মিঞার পুত্রবধূ। তিনি মাসে এখন চল্লিশ টাকা আয় করিতে পারেন।
রানাঘাটের সেই মেয়েটি মিস্ত্রীর কাজে খুব দক্ষ হইয়া উঠিয়াছেন। লেখাপড়ায়ও তাঁহার বিলক্ষণ আগ্রহ। অবসর সময়ে এবং অনেক রাত্রি পর্যন্ত তিনি লাইব্রেরিতে বসিয়া বই পড়েন। এক ব্রাহ্মণ ডাক্তার চিকিৎসার জন্য আসিয়া তাহাকে দেখিয়া যান। তিনি সম্প্রতি রায়হানের কাছে একখানি আবেগপূর্ণ পত্র লিখিয়াছেন–তিনি তাহাকে বিবাহ করিতে চান।
রায়হান কিংবা করিমাকে দেখিয়া ছাত্রীরা কোনো সঙ্কোচ বোধ করে না। তাহারা যে। কাহারো অনুগ্রহে সেখানে পালিত হইতেছে একথা তাহাদিগকে ভাবিতে হয় না।
আজিজের স্ত্রীর স্বভাব অতি সুন্দর। স্বভাবে সে সকলকে মুগ্ধ করিয়াছে। সকল ছাত্রী। তাহাকে ভালবাসে। সে পুস্তক বাঁধাই এবং সেলাইয়ের কাজ শিখে। বাহির হইতে ব্যবসায়ী দপ্তরী আসিয়া প্রতি শনিবারে বই দিয়া যায় এবং বাঁধা বইগুলি লইয়া যায়। একজন ছাত্রীকে বই বাঁধাই শিখাইতে মাত্র তিন মাস লাগিয়াছিল–সেই ছাত্রীটি এখন সকলকে কাজ শিখাইয়া লইয়াছে।
হিন্দু ছাত্রীরা স্বতন্ত্র খায়, মোসলমান ছাত্রীরাও ভিন্ন খায়।
দিন রাত্রির ব্যস্ততায় কাহারও মনে কোনো কুভাব আসে না। কিরণবালা ছাত্রীদের সহিত পাঁচবার নামাজ পড়েন। প্রাতঃকালে আজিজের স্ত্রী অনেকক্ষণ ধরিয়া কোরান পাঠ করে।
ফুর্তি ও উল্লাসের জন্য প্রতি বৈকালে হেডমিস্ট্রেস সাহেবা ছাত্রীদিগকে লইয়া পুরুষ ছেলেদের মতো নানাবিধ ক্রীড়া করেন। সখাওত মিঞা এবং মিস্ত্রীকে সে সময় বাহিরে যাইতে হয়।
প্রত্যেক ছাত্রীর নামের পূর্বে মাতা শব্দ যোগ করিয়া দেওয়া হইয়াছে। নাম উচ্চারণ করিবার সময় সঙ্গে সঙ্গে মাতা শব্দটি বলিতে হয়।
কোনো ছাত্রী কোনো অসভ্যতা বা নীচতার পরিচয় দিলে হেডমিস্ট্রেস মিষ্ট কথায় তাহার ত্রুটি বুঝাইয়া দেন। কাহারো সহিত কোনপ্রকার কঠিন ব্যবহার করা হয় না।
ভোগবিলাস অপেক্ষা সংযমের কথাই ছাত্রীদিগকে বেশি বলা হয়। যদিও স্পষ্টভাবে কিছু প্রকাশ করা হয় না, কথায় ও কাজে এমন ব্যবহার করা হয় যাহাতে তাহাদের মন। ভোগ অপেক্ষা সংযমের দিকে বেশি অনুরক্ত হয়। কাহাকেও কঠিনভাবে কিছু বলা হয় না।
৪১-৪৪. আমেনা যে নিতান্ত মূহ্যমান
একচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ
আমেনা যে নিতান্ত মূহ্যমান হইয়া পড়িয়াছিল তাহা নহে। তবুও রায়হানের করুণ হৃদয়। তাহাকে ভুলিতে পারে নাই। আমেনার জন্য তাহার হৃদয়ে সদাই একটা বেদনার ধারা বহিয়া যায়। আমেনার সম্মুখে মন খুলিয়া প্রাণ ভরিয়া হাসিতেও তাঁহার ভয় হয়।