জেলার ম্যাজিস্ট্রেটের সাহায্যে রায়হান যখন বীরনগর দারোগা বাড়ি হইতে আমেনাকে উদ্ধার করিলেন তখন তাহার আনন্দের সীমা রহিল না।
দারোগার পরিবারবর্গ ব্যাপার কিছু না বুঝিতে পারিয়া অবাক হইয়া রহিল।
.
ঊনচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ
আসল কথা কেহ জানিল না। জানিল কেবল আমেনার মা। তিনি আঁখি-জলে রায়হানের হাত জড়াইয়া ধরিয়া কহিলেন–“বাবা, তোমাকে দিবার আমার কিছুই নাই?।
তালাক যখন হইয়াই গিয়াছিল তখন রায়হান সাধারণের অবগতির জন্য জেল হইতে হামিদকে কারণ নির্দেশ না করিয়াই আমেনার জন্য নূতন তালাকপত্র পাঠাইয়া দিতে। অনুরোধ করিয়াছিলেন। হামিদ তাহা করিয়াছিল। ফাঁসি তাহার হয় নাই। দারোগার বিনা চেষ্টাতেই তাহার মাত্র ছয় মাসের জেল হইয়াছিল। ভীরু হামিদ কাহারো আশ্বাস না মানিয়াই স্ত্রীকে গোপনে পরিত্যাগ করিয়াছিল।
তখন বর্ষাশেষের একটু একটু শীত। সবে শিশির পড়িতে আরম্ভ হইয়াছে। ডোবার ভিতর শেওলার পাতায় হিমকণাগুলি ঝ ঝক্ করিতেছিল। ডোবার মাঝখানে শুভ্র দুটি মৃণাল-প্রভাতে পুণ্য হৃদয়ের পবিত্রটুকু লইয়া আপন মনে জড়াইয়াছিল।
রায়হান দূর হইতে দেখিলেন, ঊষার শিশিরে খালি পায়ে শুভ্র বসনে আমেনা জলের শান্ত সৌন্দর্যের পানে অনিমেষে তাকাইয়া আছে।
কী জানি কেন রায়হানের বুকখানি সহসা কাপিয়া উঠিল। একটা করুণ আবেগ নিমিষের জন্য তাহার বিশ্বাসকে রুদ্ধ করিয়া গেল।
রায়হান তাড়াতাড়ি দোকান-ঘরে চলিয়া গেলেন।
দরজা খুলিয়া, ডাস্টার দিয়া টেবিলখানা, আলমারিগুলি চেয়ার দুইখানা, বইয়ের তাকটি পরিষ্কার করিয়া ফেলিলেন।
তাহার মনে আজ সহসা যেন কীসের একটা স্পর্শ লাগিয়াছে। একটা বেদনা ঘুরিয়া ঘুরিয়া তাহার চিত্তকে অধীর করিয়া তুলিতেছিল।
দরজার কাছে চেয়ারখানি টানিয়া লইয়া রায়হান বাহিরের দিকে চাহিয়া মৃদুস্বরে করুণ বেদনায় বলিয়া উঠিলেন–“আমেনাকে কী করা যায়?”
নিত্য মানুষের মঙ্গল খুঁজিয়া রায়হান যতটুকু আত্মপ্রসাদ লাভ হইত আজ তাহা সামান্যই বোধ হইতেছিল।
আমেনাকে রায়হান আজ কয়েক মাস হইল দারোগার বাড়ি হইতে লইয়া আসিয়াছেন। এই কয়মাস তিনি ভিতরে ভিতরে একটু সুখই অনুভব করিয়া আসিতেছিলেন। আজ কিন্তু সে সুখানুভূতি তাঁহার কাছে যথেষ্ট বলিয়া মনে হইতেছিল না।
রায়হান ভাবিলেন–এই স্নেহময়ী বালিকাটি সংসারের কাছে কী অপরাধ করিয়াছে–যার জন্য তার উপর সংসারের এই শাস্তি? নিজে আমেনার কী উপকার করিয়াছেন? কিসের জন্য আমেনা তাহাকে এত শ্রদ্ধা করে?–সে আমেনাকে জ্ঞান দিয়াছে, এই জন্য? যে জ্ঞানে আমেনার কিছুমাত্র সুখ বাড়ে নাই, সে জ্ঞানের মূল্য কী? সেই পুরোনো বিশ্বাস–“বিধাতা বন্ধুকে দুঃখ দান করেন” এ কথা রায়হান বিশ্বাস করতে রাজি নন। দুঃখকে দূর করাই তাঁর জীবনের আনন্দ। সম্মুখে এই ধূমায়িত সুখ ও আনন্দবাঞ্জিতা আমেনাকে ভালবাসিয়া, রায়হান ভাবিতেছিলেন–তার কাছে সকল সুখই হারাম।
রায়হান আবার ভাবিলেন–“দুইবার তাহাকে বিবাহ দেওয়া হইয়াছে। পাড়ার কেউ কেউ আমেনা সম্বন্ধে একটা অপ্রিয় কথা আলোচনা করিয়া তার ভাঙ্গা মর্যাদাটুকুকে আরও খাট করিয়া ফেলিবে না, তারই বা বিশ্বাস কী?”
আমেনা শান্ত মৌন নিষ্পাপ বালিকা, তার হৃদয়ের মর্যাদা রায়হান ছাড়া আর কে জানে! মানুষ তার বিশ্বাস মানিয়া লইবে কী? অবিশ্বাস ও সন্দেহ আমেনার বুকখানাকে কেমন করিয়া রক্তময় করিবে, রায়হান তাহা বুঝিলেন এবং শিহরিয়া উঠিলেন।
এই বয়সে আমেনার আবার বিবাহ হওয়া দরকার। কিন্তু কোথায়? কে তাহাকে বিবাহ করিবে? তাহাকে সন্দেহ করিবার সুযোগ বিধাতা অনেকখানি মানুষকে দিয়াছিলেন। সে আঘাত আমেনা সহ্য করিতে পারিবে কি? কোন অপদার্থ সৌন্দর্যলোলুপ রূপভিখারি আমেনাকে বিবাহ করিতে আসিতে পারে কিন্তু যেখানে স্বামীর স্ত্রীর ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধা নাই যেখানে স্ত্রী কি তিষ্টিতে পারে?
কোনো হীন দুর্মতি যদি আমেনাকে বিবাহ করিতে আসে তাহা হইলে আমেনা কতখানি ব্যথিত হইবে? আমেনা কেমন করিয়া এই অত্যাচার সহ্য করিবে?
দোকান-ঘর বন্ধ করিয়া রায়হান বাহির হইয়া পড়িলেন।
বৈঠকখানায় বসিয়া করিমার বাপ কোরানের অর্থ পড়িতেছিলেন?! রায়হানকে দেখিয়া তিনি বলিলেন, “বাবা, তোমার শিল্পবিদ্যালয় হতে আমাকে দুইখানি নূতন চেয়ার তৈরি। করে দিও।”
রায়হান সালাম করিয়া কহিলেন–“চাচাজান, আপনারই তো সব।”
বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিয়া রায়হান দেখিলেন, করিমা বারান্দায় বসিয়া কলে জামা সেলাই করিতেছেন।
রায়হান আদাব করিয়া কহিলেন, “খুব কর্মী, এক মুহূর্তও নষ্ট হবার যো নাই।”
করিমা বলিলেন,–“সব চাপ আপনার উপর দিয়ে আমি নিজে নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকি, এই আপনার ইচ্ছা?”
রায়হান কুণ্ঠায় কহিলেন–“না, না! সে কথা নয়।” করিমার মা সেখানে বসিয়াছিলেন। রায়হান সালাম করিয়া তাহার কুশল জিজ্ঞাসা করিলেন।
করিমার মা স্নেহমাখা স্বরে রায়হানকে বসিতে বলিলেন। মেয়ে ও রায়হানের পাছে। কথা বলিতে লজ্জা বোধ হয়; তিনি কাজের বাহানায় উঠিয়া গেলেন।
রায়হান বলিলেন–“বুবু, আমেনা তোমার ও আমার স্নেহ ও সহানুভূতি ছাড়া বাঁচবে। এই ব্যথিত বালিকার জন্য তোমার কতখানি বেদনা বোধ হয়, তা আমি জানতে চাই। আমি ইচ্ছা করি, তোমার ও আমার বিশ্বাস এবং ভালবাসায় তার জীবনের বেদনা অনেকটা কমে যাক।”