গাড়ি আসিলে দ্বিরুক্তি না করিয়া আমেনা ধীর পদবিক্ষেপে গাড়ির ভিতরে যাইয়া উপবেশন করিল।
গাড়িতে উঠিবার পূর্বে অন্ধকারে তাহার চোখ দিযা খানিক জল গড়াইয়া পড়িল, অঞ্চলে তাহা মুছিয়া ফেলিল। তাহার এই দুঃখ ও অসম্মানের কথা একটা লোকের কাছেও সে বলিতে পারে না–সে যে রমণী! কথাগুলি যে লজ্জাজনক!
যথাসময়ে পাল্কি হইতে নামিয়া আমেনা বিস্ময়ে চাহিয়া দেখিল, দেউড়ীতে কলা গাছ এবং মঙ্গলঘট রাখিয়া দেওয়া হইয়াছে। ঘটের মুখে ফুল ও আম পাতা। দুইজন রমণী সেখানে দাঁড়াইয়াছিল। হাতে তাহাদের ফুলের ডালা।
আমেনাকে খুবই সম্ভ্রমের সহিত নামাইিয়া লওয়া হইল। দারোগার মায়ের মতোই একটি স্ত্রীলোক পাল্কির ভিতর আসিয়া আমেনাকে চুম্বন করিলেন।
অতঃপর আর একজন বলিষ্ঠকায়া যুবতী আমেনাকে কোলে তুলিয়া বাড়ির মধ্যে লইয়া গেল এবং সেখানে তাহাকে মুল্যবান একখানা মখমলমণ্ডিত বিছানায় বসান হইল।
আমেনার ইচ্ছা হইতেছিল, সে চিৎকার করিয়া বলে–ওগো, সে কেউ নয়। প্রাণের দায়ে তাহাকে তার স্বামী দারোগাকে উপহার দিয়াছে–সে দারোগার বিবাহিত পত্নী নহে। ছিঃ ছিঃ! কেমন করিয়া সে এমন লজ্জাজনক কথা সকলের কাছে প্রকাশ করিয়া দিবে! সে দারেগার পত্নী নহে, সে কি তবে পথের রমণী–একজন রক্ষিতা?
আমেনা স্তব্ধ হইয়া চুপ করিয়া রহিল। একটা কথাও তাহার মুখ দিয়া বাহির হইল। কেহ সন্দেহ করিল না। সকলেই জানে, নূতন বধূ কাথা বলেন না।
নববধূর রূপ দেখিয়া সকলেই মুগ্ধ হইলেন।
মোট কথা আমেনার প্রতি খুবই সম্মান প্রদর্শন করা হইতেছিল। বাড়ির ছেলেরা এবং চাকরানীরা আসিয়া আসিয়া আমোনার পদ চুম্বন করিল। পোলাও-কোর্মা প্রস্তুত ও ছাগ। জবেহের ব্যবস্থা হইল। আমেনার সম্মুখে এই ব্যঙ্গ অভিনয় সমস্ত দিন ধরিয়া চলিল।
সন্ধ্যা-রাত্রে দারোগা সাহেব আমেনার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলে আমেনা বিছানা ছাড়িয়া গৃহের পার্শ্বে যাইয়া দাঁড়াইল।
দারোগা মৃদুস্বরে অতি সাবধানে কহিল, “ক্ষমা করিবেন–আপনার কোনো ভয় নাই। আপনি আমার স্ত্রী, এই কথা সকলকে বলিয়াছি, সুতরাং আপনি কাহাকেও অন্য কিছু বলিবেন না। আগামীকল্য আমি কর্মস্থানে চলিয়া যাইব, যথাসময়ে সম্মানের সতি অথচ গোপনে আমি আপনাকে বিবাহ করিব। আপনার কোনো ভয় নাই।”
.
অষ্টত্রিংশ পরিচ্ছেদ
দিল্লী হইতে বাড়িতে ফিরিয়া আসিয়া যখন রায়হান হামিদের বাড়িতে আমেনার সহিত দেখা করিতে গেলেন-তখন হামিদ কাঁদিয়া কহিল–আমেনাকে সে কলিকাতায় বিসর্জন দিয়া আসিয়াছে। সে আমেনাকে লইয়া কলিকাতায় বেড়াইতে গিয়াছিল, ভিড়ের মধ্যে আমেনা কোথায় হারাইয়া গিয়াছে।
গভীর দুঃখে রায়হানের কয়দিন কাটিয়া গেল। হামিদ অনেকবার হাসিয়া রায়হানকে বিধির বিধান মানিয়া লইতে বলিয়া গেল, কিন্তু তবুও রায়হান শান্ত হইতে পারিলেন না।
হামিদ যে দিন এই ভয়ানক সংবাদ রায়হানকে দিয়া গেল সেদিন হইতে পঞ্চম দিনে তিনি একখানা বিয়ারিং পত্র পাইলেন। পত্রে যাহা লেখা ছিল তাহা পড়িয়া রায়হান বজাহতের ন্যায় মাটিতে বসিয়া পড়িলেন।
পত্রখানি এইরূপ :
বীরনগর
প্রিয় ভাইজান,
এই পত্র পাইয়া আপনার মনের অবস্থা কেমন হইবে, তাহা বুঝিতেছি না। আপনারা এবং আমার স্বামী কেমন করিয়া আমার অস্তিত্বকে মুছিয়া ফেলিতে সক্ষম হইয়াছেন বুঝিতেছি না।
এই পত্র আপনি পাইবেন কিনা জানি না। কলিকাতা বেড়াইবার ওছিলায় আমার স্বামী আমাকে বাড়ির বাহির করেন। স্বপ্নেও ভাবি নাই, আমার মাথায় এই বজ্রাঘাত হইবে। কুমারপুর রেলস্টেশনে আমার স্বামী আমাকে হত্যা করি। নির্বিঘ্নে বাড়ি ফিরিয়া গিয়াছেন। সঙ্গে একখানি পত্র পাঠাইলাম। পড়িয়া দেখিবেন আমাকে কীভাবে পরিত্যাগ করা হইয়াছে। আমি এখন বীরনগর দারোগার বাড়িতে দারোগার স্ত্রীরূপে আছি। আমার মনের উপর কি ভয়ানক কষ্ট হইতেছে, খোদাই জানেন! বিবাহের পর হইতে আমার যে কত অসম্মানের বোঝা চাপান হইল তাহার ইয়ত্তা নাই। যদি উদ্ধারে আমার অসম্মান আরও বর্ধিত হয়, তবে উদ্ধারে কাজ নাই। নিজের বেদনা লইয়া নিজেই শুকাইয়া মরিব। এই জন্যই কি আমায় লেখাপড়া শিখাইয়াছিলেন?
স্ত্রীলোকের জীবন কি এতই তুচ্ছ? একটা খেলনার যে মূল্য আছে আমার জীবনের তাহাও নাই। গৃহপালিতপশুর জীবন ছাড়া আমার জীবন আর কী?
ভাইজান! কোথায় আপনি? কোথায় আমার আত্মীয়-স্বজন আমাকে উপহাস করুক–আপনিও কি আমায় উপহাস করিবেন? আমাকে রক্ষা করুন। তাহার পর নিজের কাছে স্থান দিয়া আমার সম্মান রক্ষা করুন। কেউ আমাকে চিনিবে না। ইহার পর হয়তো আমার মূল্য এক পয়সাও হইবে না। লজ্জা এবং পৃথিবীর অবহেলা হয়তো আমার পক্ষে অসহনীয় হইয়া উঠিবে। এই পত্র আমি দারোগা সাহেবের ছোট ছেলের সাহায্যে ডাকে দিতে সক্ষম হইয়াছি।”
পত্র পড়িয়া রায়হান দুই হস্তে বুক চাপিয়া ধরিয়া বেদনায় মাটিতে বসিয়া পড়িলেন। তাঁহার উন্নত হৃদয় অতি প্রিয়তম ছাত্রীকে লইয়া পৃথিবীর এ কী কৌতুকঃ অসহ্য বেদনায় রায়হানের চক্ষুও বক্ষ অশ্রুধারায় ভিজিয়া গেল। কিন্তু বিলম্ব করিলে চলিবে না। হয়তো কাঁদিবার কোনো সময় নাই।
রায়হান অনেকক্ষণ বসিয়া চিত্তকে সংগত করিয়া কী যেন ভাবিয়া লইলেন–তাহার পর তিনি সহসা কাপড় পড়িয়া কাহাকেও কিছু না বলিয়া রেলস্টেশন অভিমুখে যাত্রা করিলেন।