“এ কথা প্রকাশ উপযোগী নহে। তাই এই কৌশল অবলম্বন করিয়াছি। আশা করি তোমার মহত্ত্ব আমার এই হীনতাকে স্বীকার করিয়া লইবে। আমার বিশ্বাস, নারী হইলেও মনুষ্যত্বে তুমি আমার চেয়ে বড়।
“মোকদ্দমায় হয় আমার ফাঁসি, না হয় দ্বীপান্তর হইবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
দারোগা সাহেব বলিয়াছেন, কিছুতেই তিনি আমার মুক্তির জন্য সাহায্য করিতে প্রস্তুত হইতে পারেন না, তবে যদি আমি আমার রূপবতী ও গুণবতী ভার্ষা দয়া করিয়া তাহার জন্য পরিত্যাগ করি তাহা হইলে ভার্ষা-বিনিময়ে তিনি আমার উদ্ধারকল্পে প্রাণপণে চেষ্টা, করিবেন।
“রায়হান ভাই প্রাণপণে চেষ্টা করিলেও তিনি কী সাহায্য করিয়া উঠিতে পারিবেন বুঝিতেছি না।
“আমি তোমাকে ত্যাগ করিয়া নিজকে বিপদমুক্ত ও নিষ্কন্টক করিতে চাই”।
“রাত্রি ১টার ট্রেনে দারোগা সাহেব এবং একজন বৃদ্ধা আসিবেন। দুইটার সময় যে গাড়ি আসে সেই ট্রেনে তুমি সেই মহিলা ও দারোগা সাহেবসহ গাড়িতে উঠিবা।”
“কথাটা তুমি ভালো করিয়া বুঝিয়াছ কিনা বুঝিতেছি না। শোন, এই দারোগা সাহেব তোমাকে বিবাহ করিয়া প্রাণপণে আমাকে বাঁচাইতে চেষ্টা করিবেন। অবশ্য তোমার সহিত তাঁহার বিবাহ খুব সম্মানের সহিত হইবে। তোমার প্রতি কোনো প্রকার অসম্মান বা অত্যাচার দেখান হইবে না।
“শেষ কথা, তুমি যদি এ প্রস্তাবে অসম্মত হও তাহা হইলে দারোগা সাহেব ভায়ানক ক্রুদ্ধ হইবেন। তাহার অত্যাচার ও অবিচারের সম্মুখে তুমি রমণী–সুতরাং তিষ্টিতে পারিবে না। পুরুষ ইচ্ছা করিলে রমণীর মাথায় কলঙ্ক ও অসম্মান চাপাইয়া দিতে পারে।”
“দারোগা সাহেবের মতের বিরুদ্ধে কোনো কাজ করিবে না। তিনি তোমাকে খুব শ্রদ্ধার সহিত ভালবাসিবেন। তুমি তাহার আদরের ছোট বৌ হইবে। যত শীঘ্র সম্ভব তোমাকে কলিকাতায় লইয়া বিবাহ করিবেন।”
চক্ষু মুছিতে মুছিতে আমেনা দ্বিতীয় পত্রখানি পড়িয়া দেখিল–সে-খানিতে তাহাকে ত্যাগ করা হইয়াছে।
.
সপ্তত্রিংশ পরিচ্ছেদ
আমেনা ভাবিয়া ঠিক পাইল না, সে কি করিবে, কাহার কাছে সে যাইবে? চরণ যেন তাহার শক্তি থাকিলেও শক্তিহীন। সে ইচ্ছা করিল, মুহূর্ত বিলম্ব না করিয়া অন্ধকারে পলায়ন করে, কিন্তু তারপর সে কোথায় যাইয়া দাঁড়াইবে?
তাহার ইচ্ছা হইল একবার সে চিৎকার করিয়া সকলকে ডাকিয়া বলে তাহার উপর কতবড় অত্যাচার হইতে যাইতেছে। কিন্তু হায়! বড় করিয়া কথা বলিতে সে কোনো দিন অভ্যস্ত নয়। মানুষের কাছে নিজের কথা বলিবার দাবি করা তো দূরের কথা, পরপুরুষের সম্মুখে একাকী কেমন করিয়া যাইবে?
তাহার ইচ্ছা হইল যেমন করিয়া পারে সে কিছুতেই এই অসম্মান সহিবে না।
একবার তাহার মন তাহার স্বামীর উপর অত্যন্ত বিদ্রোহী হইয়া উঠিল। দারোগাকে বিবাহ করিয়া এই কাপুরুষকে পরিত্যাগ করিলে কী ক্ষতি? স্ত্রীর সম্মান রক্ষার জন্য মানুষ প্রাণ দিতে কুণ্ঠিত হয় না, আর এই নরাধম স্ত্রীকে কলঙ্কিত করিয়া স্বীয় প্রাণ রক্ষা করিতে ব্যস্ত!
কিন্তু সবই তো শেষ হইয়া গিয়াছিল।
আমেনা স্তব্ধ হইয়া ওয়েঠিংরুমে বসিয়া রহিল। যথাসময়ে একটার ট্রেন আসিল। আমেনার বুকখানি কাঁপিয়া উঠিল।
আবার আমেনার ইচ্ছা হইল, সে দৌড়াইয়া পলায়ন করে, কিন্তু তার কাপুরুষ স্বামী হয়ত যমদূতের মত দরজার কাছে দাঁড়াইয়াছিল। তা ছাড়া রমণীর স্বামী ছাড়া এ জগতে কে আছে? তার স্বামীই যখন তাহাকে পরিত্যাগ করিতেছেন তখন সে একা কোথায় যাইয়া দাঁড়াইবে? পথ চিনিয়া এবং একাকিনী সে বাড়িই-বা যাইবে কেমন করিয়া? সে তো এখন একেবারেই সহায়শূন্যা। দারোগার কাছে–সে যত বড় নরপিশাচই হউক–একটি আশ্রয় তো পাওয় যাইতেছে। আমেনা ভাবিল-কর্তব্য কি তাহা তাহার বাড়িতে যাইয়া ধীরভাবে ঠিক করা যাইবে?। সে আরও ভাবিল–তাহার নিজের পক্ষে ভয়ানক অসম্মানজনক হইলেও তাহার সহিত দারোগা পথের রমণীর ন্যায় ব্যবহার করিতেছেন না। সে আবার ভাবিল, স্বামী যাহাকে পথের মাঝে পরিত্যাগ করে, তার ভবিষ্যৎ তো অন্ধকার। সহসা দরজার কাছে একটা আঘাত হইল। আমেনা চাহিয়া দেখিল, একটা প্রৌঢ়া রমণী, হাতে তার কতগুলি ফুল। কক্ষে কাপড় দিয়া বাঁধা একটা পোটলা।
কোনো কথা জিজ্ঞাস না করিয়া প্রৌঢ়া আসিয়া আমেনার পদচুম্বন করিল এবং পোটলা খুলিয়া সুন্দরী রমণী ব্যজনী লইয়া আমেনাকে বাতাস দিতে আরম্ভ করিল।
মুহূর্তকাল ব্যজনী দোলাইয়া রমণী কহিল–“দারোগা সাহেব আপনাকে সালাম পাঠিয়েছেন।” অতঃপর পোটলার ভিতর হইতে উত্তম রসনা-তৃপ্তিকর মিষ্টান্ন বাহির করিয়া কহিল–“কিছু জলযোগ করে গাড়ির জন্য প্রস্তুত হন।”
আমেনা কোনো কথা কহিল না।
রমণী আমেনাকে আবার খাইতে অনুরোধ করিল। তাড়াতাড়ি একটা রৌপ্যের গ্লাসে। বাহির হইতে জল আনিয়া আমেনার হাত ধুইয়া দিল।
বিস্মিত ক্রোধ চাপিয়া রাখিয়া আমেনা মৃদুস্বরে কী কহিতে যাইতেছিল। রমণী সে কথা
শুনিয়া তাহার হাতের উপর খানিক মিষ্টান্ন রাখিয়া আমেনার মুখের কাছে ধরিল।
মুহূর্তের মধ্যে আমেনা কী যেন ভাবিয়া লইল। তাহার পর সে সহজভাবে খাইতে বসিল। আহার শেষ করিয়া মনের ভাব চাপিয়া রাখিয়া আমেনা মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করিল ”দারোগা সাহেবের বাড়ি কতদূর?”
রমণী কহিল–“এই দুই স্টেশন পর। বেশি নয়।”