অভ্যাস মতো রায়হান উপস্থিত অক্ষমতা বিস্মৃত হইয়া উঠিয়া বসিতেছিলেন। করিমা ক্ষিপ্রভাবে রায়হানকে নিরস্ত করিয়া কহিলেন–“আপনার শারীরিক অবস্থার কথা আপনি হয়তো ভুলে গিয়েছেন। একটুও নড়বেন না।”
রায়হান লজ্জিত হইয়া বলিলেন–“ক্ষমা করবেন, আমি ভুলে গিয়েছিলাম।”
অতঃপর আমেনাকে বলিলেন–“থাক বু আর দরকার নেই। তুমি আর কত খাটবে? তোমার শরীর খারাপ হবে। চাচি তো আছেন?”
নফিসা বলিলেন–“তুমি আর সে সব কথা ভেবো না, বাপু। মেয়েমানুষের কষ্ট করাতেই সুখ। সেবাতে তাদের আনন্দ।”
রায়হান অনেকক্ষণ নিস্তব্ধ থাকিয়ে মৃদুস্বরে কহিলেন–“করিম! কতদিন আমাকে বিছানায় পড়ে থাকতে হবে? বিদ্যালয়ের সব কাজ সেরে নেওয়া আপনার একার পক্ষে খুবই কঠিন হবে। আমেনা। শুন, সহরবানু তো লেখাপড়ায় খুব উন্নতি করেছে। পড়ার কাজ তাদের হাতে দিয়ে আপনি শুধু সেলাই শিক্ষা দিতে থাকুন। এখানে যে আয় হবে তাতে যদি মেয়েদের বোর্ডিং খরচ না পোষায় তা হলে আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবেন। শান্তিপুর থেকে সে ছেলেটি শীঘ্রই কাপড় তৈরি করা শিখে আসবে।”
করিমা ব্যথিত সুরে বলিলেন–“এখন আপনার কোনো কথা না বলাই ভালো। এখন আপনার নিরবচ্ছিন্ন শারীরিক ও মানষিক বিশ্রাম আবশ্যক।”
“এই সমস্ত কথা ভাবিয়াই আমি সুস্থ হব” বলিয়া রায়হান চুপ করিলেন।
.
পঞ্চত্রিংশ পরিচ্ছেদ
দীর্ঘ চার মাস পর বিছানা হইতে উঠিয়া রায়হান হামিদকে যথেষ্ট আশ্বাস দিয়া দিল্লী চলিয়া গিয়াছেন। বলিয়া গিয়াছেন, যত শীঘ্র সম্ভব ফিরিয়া আসিবেন। রায়হানের দিল্লী যাইবার পর নির্জন নদীর ধারে আঁধারে দারোগা সাহেব একদিন হামিদ মিয়াকে বলিতেছেন–“আপনার বাঁচবার আশা নাই।”
হামিদ জড়িত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন–“কোনো আশা নাই দারোগা সাহেব?” হয় দ্বীপান্তর, না হয় ফাঁসি।”
“না, কোনো আশা নাই। আইনের বই খুলে দেখুন। হয় দ্বীপান্তর, না হয় ফাঁসি।”
আঁধারে হামিদের শুষ্ক রক্তহীন মুখখানি দেখা যাইতেছিল না। ভবিষ্যতের বিভীসিকাময় মরণদৃশ্য তাহার বুকখানি স্পন্দিত করিয়া গেল।
ভাব ও করুণাহীন কঠিনতায় অভ্যস্ত দারোগাবাবু কহিলেন–“আপনার উৎসাহে কুড়িজন মানুষ খুন হয়েছে। আপনি নিজে পাঁচ জনকে হত্যা করেছেন। আইনকে অমান্য করতে কেউ পারে না।”
“আমি মুসলমান মুসলমানের উপকার করা কি আপনার কর্তব্য নহে? এই হত্যাকাণ্ডের মূল হিন্দুরা, তারা যদি মুসলমানদিগকে কোরবানি করতে বাধা না দিত তা হলে এ-ঘটনা কখনও ঘটত না।”
“মানুষ হত্যা কোনো রকমে সমর্থন করা যায় না।”
হামিদ স্তব্ধ হইয়া একবার আকাশের দিকে চাহিল। কঠিন ভায়বাহ মৃত্যুকে সে কেমন করিয়া আলিঙ্গন করিবে? মৃত্যু যে এত ভয়ানক তাহা সে কল্পনায়ও আনিতে পারে নাই। কতবার সে মৃত্যুকে উপহাস করিয়াছে। কর্তব্য ও মহত্ত্বের অনুরোধে মরণকে সে মহিমা ভরা বলিয়া সকলের কাছে ঘোষণা করিয়াছে। কিন্তু সে আজ নিজকে নির্দোষ মনে করিয়াও মৃত্যুকে উপহাস করিতে পারিতেছে না। সে বড় বিপন্ন।
সে যদি অপরাধীই হল তবে তাহার মরণে এত চাঞ্চল্য কেন? সে অপরাধকে কী দিয়া ঢাকিবে? দীর্ঘ পার্থিব জীবন অনুতাপ-বেদনার কঠিন আঘাতে সে কত রাঙা হইয়া উঠিবে! জীবনে তার অপরাধের ভার কমিবে কী?
এই আলো ও গানে-ভরা পৃথিবীকে কিনিয়া রাখিবার জন্য সে সব দিবে। সে পথের ফকির হইবে। সে আবার ভাবিল–একটুও কি আশা নাই?
কত সুন্দর এই পৃথিবী! হামিদ কত বইতে পড়িয়াছে–পৃথিবী কিছু নয়–মৃত্যুর ভিতর দিয়া আমরা অনন্ত জীবন লাভ করি। কিন্তু আজ তাহার একি দুরবস্থা।
হামিদকে নিস্তব্ধ দেখিয়া দারোগা সাহেব করিলেন–“একটা পথ আছে। কিন্তু তাহাতে আমার চাকরি না থাকতে পারে।”
একটু উৎসাহিত হইয়া হামিদ নত হইয়া দারোগার পা ছুঁইয়া কহিল–“একজনকে উপকার করতে যেয়ে আপনি না হয় বিপন্নই হবেন। খোদার কাছে আপনার গৌরব হবে।”
দারোগা হামিদকে বাধা দিল না। সোজা ও কঠিন হইয়া সে দাঁড়াইয়া রহিল।
হামিদের কাতর কথায় একটু হাসিয়া দারোগা কহিল–“শুন, আমি তোমার স্ত্রীর রূপ ও গুণের কথা শুনেছি। তাকে যদি তুমি ত্যাগ করতে পার তাহা হলে নিজেকে বিপন্ন করে তোমাকে বাঁচাতে চেষ্টা করতে পারি।”
৩৬-৪০. কুমারপুর রেলস্টেশনে মেয়েদের ওয়েটিংরুমে
ষট্ত্রিংশ পরিচ্ছেদ
উপরি উক্ত ঘটনার কয়েকদিন পর কুমারপুর রেলস্টেশনে মেয়েদের ওয়েটিংরুমে এক অস্পরীতুল্যা বিংশতি বর্ষীয়া যুবতী দুইখানি পত্র হাতে করিয়া স্নিগ্ধ প্রদীপ আলোকে দাঁড়াইয়াছিলেন।
রক্তলোহিত মুখখানি নত করিয়া যুবতী পত্রখানি পড়িয়া দেখিলেন।
যদি পত্র পড়িয়া সেই স্থানে যুবতী মূৰ্ছিতা হইতেন তাহা হইলে বিস্ময়ের কোনো কারণ থাকিতে পারে না।
এই যুবতী আমেনা। ওয়েটিংরুমের খোলা জানালা দিয়া আমেনা একবার মুক্ত সুন্দর নীলাকাশের পানে তাকাইল। চক্ষু এবং ওষ্ঠ তাহার কাপিয়া উঠল।
পত্র দুইখানি এইরূপ :
প্রথম পত্রে লেখা ছিল—”প্রিয়তম আমেনা! তুমি জান, আমি বর্তমানে অত্যন্ত বিপন্ন। খোদার করুণার উপর বিশ্বাস হারাইয়াছি। জানি না তুমি দুঃখিত হইবে কি সুখী হইবে। আমি জানি, তোমার স্বামীর প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগের কথা। স্বামী ছাড়া সংসারে আর তোমার কেউ নাই। নরাধমের মতো তোমা হেন ভাষা-বিনিময়ে আজ আমি নিজকে রক্ষা করিতে ইচ্ছা করিতেছি। আমি বুঝিতেছি, আমি হীন। তত্রাচ আমি ইহা না করিয়া থাকিতে পারিতেছি না। আমার মতো কাপুরুষ জগতে হয়তো আর কেউ নাই, তবুও আমি ইহা করিতেছি। আমার প্রণয় ও ভালবাসার কথা স্মরণ করিয়া লজ্জায় আমি এতটুকু হইয়া পড়িতেছি।–কত বাধার মুখে রায়হানের মধ্যবর্তিতায় তোমায় পাইয়াছিলাম, তবুও আজ তোমাকে জন্মের মতো পরিত্যাগ করিতে হইতেছে।