অন্ধকারময় কদর্য আত্মা দিয়ে কোরান পাঠ করলে কোনো লাভ হয় না, এ কথা আমি বুঝি।
রায়হান–বেশ, ক্ষতি স্বীকার করে আমি আজ হতে আমেনাকে পড়াবো। কিন্তু ঠিক যদি তাকে আমার কাছে পড়তে দিলেনই, তবে আজ হতে অন্তত চার বৎসর আমি তাকে জ্ঞান দান করবো।
নফিসা–বেশ। বিয়ের জন্য প্রথম ভাগ ও কতকগুলি ভাঙ্গা হাড়ির মতো অক্ষর তৈরি করতে শিখলেই হবে না। সে প্রথম ভাগ পড়েছে। দ্বিতীয় ভাগও শেষ করেছে। তুমি তাকে এখন ভালো ভালো কথা শিক্ষা দাও, মন যাতে তার উন্নত হয়।
আমেনা মিটমিট করিয়া মুখ ফিরাইয়া হাসিতেছিল। রক্ত ওষ্ঠ দিয়া একটু একটু করিয়া সুধা ঝরিতেছিল।
রায়হান আমেনাকে জিজ্ঞাসা করিলেন–এখন থেকে তুমি আমার কাজ বাড়িয়ে দিলে। রোজ বিকালে পড়তে রাজি আছ?
আমেনা হাসিয়া কহিল–কেন, সকল মানুষ যে সন্ধ্যাবেলা পড়ে?
রায়হান–সন্ধ্যাবেলা তোমার মাকে সাহয্য করতে হবে। একা তিনি অত কাজ করে। উঠতে পারেন না। সংসারের কাজও তোমাকে শিখতে হবে, শুধু বই পড়লে চলবে না।
হাতের কাজ শেখাও মেয়েদরে দরকার। তাছাড়া আমারও সময় হবে না। সন্ধ্যাকালে দোকান ছেড়ে আসতাম। এখন থেকে ঘণ্টাখানেক আগেই আসবো।
আমেনা–আমার পড়তে খুব ইচ্ছা করে। বাংলায় আমি পুঁথি লিখবো।
রায়হান বিস্মিত হইয়া বলিলেন–বটে, তোমার এত বড় কল্পনা! ছোট কালেই যার মনে এই ভাব সে খুব শিক্ষিতা হবেই হবে।
নফিসা বলিলেন–এটা খুব বিস্ময়ের কথা নয়। এমন দিন ছিল, যখন মুসলমান নারী কত বই লিখেছেন। বেশ তো, এরূপ কল্পনা খুব ভালো।
.
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
স্কুলের ছুটির পর হামিদ, খোরশেদ ও রমেশ গ্রাম্য পথ ধরিয়া বাড়ি যাইতেছিল।
তখন বৈকাল বেলার হেমকর গাছের আগাগুলি সোনালি আভায় রাঙ্গা করিয়া তুলিয়াছিল এবং কুল-বধুরা মিত্রদের পুকুর হইতে জল লইয়া যাইতেছিলেন। তাহাদের হাসি ও কথায় পাতা আর গাছে-ঘেরা পুকুরপাড় মুখরিত হইয়া উঠিতেছিল।
স্কুল হইতে বাহির হইবার সময় চানা ও বুটওয়ালার কাছ থেকে খোরশেদ, হামিদ এবং রমেশ তিনজনেই এক পয়সা করে ছোলা ভাজা কিনিয়াছিল। লবণ আর মরিচের গুঁড়া মিশানো ছোলা খাইতে নাকি বেশ লাগে।
হামিদ বলিল–“সদর রাস্তা ছেড়ে এসেছিল। পানির তেষ্টাও খুব লেগেছে; আয় রমেশ, ঘাটে বসে ছোলা খাই।”
রমেশ বলিল–“বেশ! অনেকক্ষণ হতে আমারও জিভ দিয়ে জল ঝরছে।”
রমেশ তাদের সহপাঠী। অতঃপর তিন জনেই পুকুরধারে বসিয়া ছোলা চিবাইতে আরম্ভ করিল। রমেশ একটু দূরে বসিয়া খাইতেছিল। সে যে হিন্দু একথা খোরশেদের মনে ছিল না। খোরশেদ রমেশের দিকে অগ্রসর হইয়া অসঙ্কোচে কহিল–“রমেশ, তোরগুলি কেমন দেখি, এক মুঠ দে আমায়।”
খোরশেদ রমেশের কাপড়ের ভিতর হাত দিতেই রমেশ ঘৃণায় ক্রোধে সব বুট মাটিতে ফেলিয়া দিল।
হামিদ বিরক্ত হইয়া কহিল–“জান না ও হিন্দু। এত বৎসর একসঙ্গে পড়ে আসছ, ভুলে গেছ হিন্দুর আচারের কথা?”
খোরশেদ ততোধিক বিরক্ত হইয়া কহিল–“ফেলে রাখ তোমার আচার! হিন্দুর মুণ্ডুপাত ছাড়া আর কোনো ভালো কাজ নেই।”
মুখের কথা মুখেই রহিল। ক্রোধান্ধ খোরশেদ জুতা খুলিয়া রমেশের মুখে লাগাইয়া দিল।
হামিদ কাপড়ের ঝোলা ফেলিয়া খোরশেদের হাত ধরিয়া কাহিল–“তুমি কি পাগল হলে খোরশেদ? জুতাপেটা করলে কী কেউ জব্দ হয়? তোমার ধর্মের মহিমা কি তুমি এইভাবে প্রচার করবে?”
খোরশেদ কাপিতে কাঁপিতে বলিল–“হিন্দু ঘৃণা করবে মুসলমানকে! সম্পূর্ণ অসম্ভব। মুসলমান হিন্দুকে ঘৃণা করতে পারে।–কী অপমান! ওর কান ধরে আমি জলে চুবাচ্ছি। মুসলমান কি তার গৌরব ভুলে গেছে?”
হামিদ কহিল–“দেখ খোরশেদ, তুমি মুসলমানের মতো কথা বলছে না। মনুষ্যত্বহীন যে, সেই মানুষকে ঘৃণা করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। মানুষকে ঘৃণা করা কি খুব প্রশংসার কথা? যারা হীন তারাই এ করে। মনের উন্নতির মাঝখানটাতে এই অহমিকার পরিচয় লোকে দিয়ে থাকে। হিন্দুরা এই দোষে দোষী। তুমি এতে বিরক্ত না হলে তা’দিগকে কৃপার পাত্র মনে করতে পার। তাকে জুতো মেরে কী লাভ? মুসলমানের মহিমা কি হিন্দুকে জুতো মেরে প্রতিষ্ঠিত হবে?”
খোরশেদ অধিকতর ক্রুদ্ধ হইয়া কহিল–“রাখ তোমার বক্তৃতা। হিন্দুকে জুতোপেটা করাই উচিত। এমন পাজি ও অভদ্র জাত জগতের কোথাও নাই।” হামিদ পুনঃ নম্রভাবেই কহিল–“ছিঃ, তুমি ক্ষেপেছ। হাজার হলেও তারা আমাদের প্রতিবেশী। হিন্দু আমাদের ভাই। ইসলামের গৌরব রক্ষা করবার জন্য হিন্দুকে দেশছাড়া করতে চাও নাকি? তুমি নিজে নামাজ পড়ে থাক। মহাপুরুষ মোহাম্মদের অন্তত বড় বড় আদর্শগুলি প্রতিপালন করে থাক? খাঁটি মুসলমান মিথ্যা কথা বলতে পারে না। তুমি কি মিথ্যাকে ঘৃণা করে থাক? যথার্থ এসলামের ভক্ত পূর্ণমনুষ্যত্ব লাভের জন্য চেষ্টান্বিত হবে।–তুমি তো করে থাক? তুমি নিজের চরিত্রের মন্দ অংশটুকু ঘৃণা কর। পরের আচার-ব্যবহার নিয়ে মাথাব্যাথা করবার, দরকার কী? আসল কথা, হিন্দু তোমাকে ঘৃণা করে না। তার মনে শক্তি নাই–সে বিবেক ও সত্য অপেক্ষা সমাজকে বেশি ভয় করে। রমেশ ঘাটের মেয়েদের ভয়ে অমন করে আঁৎকে উঠেছে। সে তোমাকে সত্য করে ঘৃণা করে না। ঘৃণা করতে পারে না। কোনো, মুসলমানের কাছে সে কোনো কালে অপমানিতও হয় নাই যে, তোমার উপর আজ শোধ তুলছে। সত্য, মুসলমান হও, জ্ঞানী হও, হিন্দুর কেন, প্রত্যেক হৃদয়বান মানুষের মাথা সম্ভ্রমে তোমার কাছে নত হয়ে পড়বে। লাঠালাঠি করে কোনো ফল হয় না। বুদ্ধি, সৎস্বভাব ও তর্কের দ্বারা মানুষকে জয় করো।”