দারুণ উদ্বেগে জনতার পার্শ্বে দাঁড়াইয়া রায়হান দেখিলন, ভূতলশায়ী একটা মানুষের মাথা দিয়া রক্তধারা ছুটিতেছে। জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে তাহার মানব দুঃখকাতর হৃদয় কাঁদিয়া উঠিল। রায়হান উন্মাদের ন্যায় লোকটিকে বাঁচাইবার জন্য ছুটিলেন। হামিদ দুই হাত দিয়া রায়হানকে বুকের সহিত জড়াইয়া বাধা দিয়া কহিলেন–“এই উত্তেজিত জনসঙ্গের মধ্যে যাবেন না।”
রায়হান বিপুল বলে হামিদকে সরাইয়া ফেলিয়া ভীষণ রক্তবন্যার মধ্যে প্রবেশ করিলেন। আহত মানুষটিকে বুকের মধ্যে লুকাইয়া রায়হান উচ্চেঃস্বরে কহিলেন–“ওগো মুসলমান ভাইগণ! হিন্দু হলেও সে যে আমাদের প্রতিবেশী! আমাদের সুখ-দুঃখের সহচর। আর মেরো না। যদি মারতে হয় আমার মাথায় মার।”
মুসলমানেরা স্তব্ধ হইয়া মুহূর্তের জন্য দমিয়া গেল। সুযোগ পাইয়া সহসা আহত যুবকটি রায়হানের বুকের ভিতর হইতে উঠিয়া দাঁড়াইল।
হাতে তার তীক্ষ্ণধার দীর্ঘ বল্লম-মূর্তি ভয়াবহ। সে তখন জ্ঞানশূন্য হইয়া গিয়াছিল। তাহার চিন্তা করিবার সময় ছিল না। উন্মত্ত অধীর-পিশাচের মতো সে রায়হানের বুকের ভিতর বল্লম চালাইয়া দিল। রায়হান তখন বলিতেছিলেন–“রমেশ, ভয় নাই, তোমায় বাঁচিয়েছি”–আর কিছু বলা হইল না। রায়হান মূৰ্ছিত হইয়া মাটিতে পড়িয়া গেলেন।
হামিদের মাথায় যদি অকস্মাৎ বজ্রাঘাত হইত তাহা হইলে সে হয়তো তত উদ্বেলিত হইত না, যেমন সে হইল–এই অতি আকস্মিক হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখিয়া।
ক্রোধে-দুঃখে সহসা হামিদের শিরায় শিরায় অসুরের শক্তি খেলিয়া গেল। হামিদ মাতা-পিতা-স্ত্রী-বন্ধু সব কথা ভুলিয়া গেল। ব্যাঘের আস্ফালনে সে কহিল–“যাও সকলে, আর কেন? কোনো হিন্দুর দেহ যেন আজ আর মাথায় না থাকে।” হামিদ নিজ হস্তগুলি চালাইতে আরম্ভ করিল।
রক্ত ও শবদেহে ক্ষুদ্র ময়দানখানি আচ্ছন্ন হইয়া গেল। অতঃপর আহত রায়হানকে হামিদ ও অন্যান্য মুসলমানগণ স্কন্ধে করিয়া অশ্রু বিসর্জন করিতে করিতে প্রত্যাগমন করিলেন। রায়হানের জীবনের কোনো আশা ছিল না। ধীরে ধীরে নিশ্বাস বহিতেছিল মাত্র।
.
চতুত্রিংশ পরিচ্ছেদ
রায়হান তিন দিন পর যখন চৈতন্য লাভ করিলেন তখন তাঁহার পার্শ্বে আমেনা, হামিদ, আমেনার মা নফিসা এবং রায়হানের চাচি। রায়হানের চাচি অশ্রু বিমোচন করিতেছিলেন।
যথাসময়ে ডাক্তার আসিয়াছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে বল্লম হৃদপিণ্ড বা ফুসফুস ভেদ করে নাই। অত্যধিক রক্তস্রাবে রায়হান অত্যন্ত দুর্বল হইয়া পড়িয়াছিলেন। ডাক্তার বলিয়া গিয়াছেন, ১৫ দিনের ভিতর কী হয় ঠিক বলতে পারি না ঈশ্বরের অনুগ্রহ হইলে রোগী বাঁচবে। তবে তিন মাসের ভিতর রোগী বিছানা ছাড়িয়া উঠিতে পারিবে না।
রায়হান চক্ষু মেলিয়া বলিলেন–“একটু গরম দুধ লইয়া আসুন”।
দুধ পান করিয়া অপেক্ষাকৃত সুস্থ হইয়া কহিলেন–“এত চিন্তার কারণ কী? মানুষকে বিপদের ভিতর দিয়াই বেঁচে থাকতে হয়। ব্যস্ত হবেন না।”
অতঃপর হামিদের দিকে মুখ ফিরাইয়া কহিলেন–“একটা কথা বলি। কী কী ঘটনা ঘটেছে একটু বল। রমেশ কি বেঁচে আছে? বেচারা না বুঝে আমাকে আঘাত করেছিল।”
হামিদ রায়হানের আরো পার্শ্বে আসিয়া রুক্ষস্বরে কহিল–“রমেশের কথা জিজ্ঞাসা কচ্ছেন? যে নরপিশাচ আপনার বুকে ছুরি হেনেছিল–সে শয়তানের কথা কেন? তার মতো হতভাগ্য কে আছে? প্রাণের মমতা না করে আপনি তাকে বাঁচালেন–অথচ আপনাকেই সে হত্যা করতে উদ্যত হল! মানুষ যে এত বড় নিমকহারাম থাকতে পারে তা জানতাম না।” একটু থামিয়া হামিদ পুনরায় কহিল–“হিন্দুকে আপনি তত ঘৃণা করেন না–তার ফল হাতে হাতে পেলেন। আমিও হিন্দুকে ঘৃণা করতাম না–কিন্তু এই ঘটনার পর আমার মত একেবারে বদলে গিয়েছে। কী ভয়ানক জাতি হিন্দু। ইহাদের কাহারও স্পর্শে কোনো মুসলমানের আসা উচিত নয়।”
রায়হান দুর্বলকণ্ঠে আবার জিজ্ঞাসা করিলেন–“রমেশ বেঁচে আছে”?
হামিদ রুষ্ট অবজ্ঞায় বলিলেন–“আছে। আপনার উপর আঘাত করেই সে শৃগালের মতো মুখ ঢেকে পলায়ন করে। সমুচিত শিক্ষা দিবার জন্য তাকে ধরতে যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলাম। ধরতে পারা যায় নাই। শুনেছি, সে সেই দিনই কলিকাতায় পলায়ন করেছে।”
রায়হান–গোলমাল থেমে গিয়েছে তো?
হামিদ দৃপ্ত হইয়া কহিল–“গোলমাল থামবে? প্রত্যেক হিন্দুর মাথা যেদিন কাটা পড়বে সেই দিন গোলমাল থামবে। কী পৈশাচিক ব্যবহার! মুসলমানের উপর কী অন্যায় অত্যাচার! তাহাদিগকে সমুচিত শিক্ষা দিয়েছি। আরও দিব।”
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া রায়হান মৃদুভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন–“আমার জ্ঞানশূন্য হবার পর গোলমাল কি আরও বেড়েছিল?”
হামিদ বলিলেন–“সেদিন ১৭ জন হিন্দুকে হত্যা করেছি। একজনের ছাড়া আর কারো মৃতদেহ ধরা পড়ে নাই।”
একটা দুর্দম্য বেদনা রায়হানের বুর্কখানাকে কাঁপাইয়া গেল। কোনোপ্রকার মানসিক ক্লান্তি শরীরের পক্ষে হানিজনক ভাবিয়া একটা দীর্ঘশ্বাসে রায়হান তাঁহার সমস্ত বেদানাটুকু বুকের ভিতর হইতে ঠেলিয়া ফেলিতে চেষ্টা করিলেন।
শারীরিক এই অসুস্থতার ভিতর হামিদের এই সহানুভূতিও নিঃস্বার্থ সেবার মূলে রায়হান কেমন করিয়া বলিলেন–হামিদ, তুমি অন্যায় করেছ!
মৌন বেদনায় রায়হান পার্শ্ব ফিরিয়া শুইলেন। . আমেনা ধীরে ধীরে বাতাস করিতেছিল। এমন সময় পাল্কি হইতে অবতরণ করিয়া করিমা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলেন।