নগের সঙ্কোচের সহিত কহিল–“আপনি খুব জ্ঞানী”।
রায়াহন বাধা দিয়া বলিলেন–“আমার চেয়ে সংসারে অনেক কিছু বেশি আপনি দেখেছেন। সুতরাং আমার চেয়ে জ্ঞানী আপনি বেশি।”
নগেন হাসিয়া কহিলেন–“কোরবানির আর কদিন বাকি?”
”আর মাত্র তিন দিন।”
“এটা বুঝি আপনাদের খুব বড় পর্ব?”
“পর্ব বলা যায় না। এ-দিন বড় ভয়ানক এবং পবিত্র।”
“কেমন?”
“মহাপুরুষ ইব্রাহিম খোদার জন্য ঐদিনের পুত্রকে কোরবানি করতে আদিষ্ট হইয়াছিলেন।“
নগেন ভীত বিস্ময়ে মাথা উঁচু করিয়া বরিলেন–“বটে,তা হলে তো বড় ভয়ানক কথা।”
রায়হান শান্তভাবে কহিলেন–“হ্যাঁ, খুবই ভয়ানক কথা?”
”খোদার জন্য পুত্রকে কোরবানি করবার অর্থ কি?”
রায়হান বলিলেন–“ন্যায় ও সত্য ছাড়া খোদা আর কিছু নয়। ন্যায়ের জন্য পুত্রকে কেন, নিজকে পর্যন্ত বিশ্বের মহামানুষেরা কোরবানি দিয়ে থাকেন। সব ধর্মেই বলে সত্য ও ন্যায়ের জন্য কষ্ট স্বীকার করাই আত্মার লক্ষ্য। এ কথা জানিয়ে দেবার জন্য খোদা প্রত্যেক মুসলানকে কোরবানি করতে আদেশ দিয়েছেন। কোরবানি মুসলমানের শ্রেষ্ট ধর্ম। পৃথিবীর সকল সভ্য জাতি কার্যত ইসলামের এই আদেশ পালন করে থাকেন। আপনাদের মহাশক্তির সম্মুখে জীব ও পুরোনো কালের নরবলির সহিত ইহার সম্বন্ধ আছে কি?”
“আমি তা জানি নে বাবা। পণ্ডিতেরা জানে।”
“আমি অনেক ঠাকুরকে বলির অর্থ জিজ্ঞাসা করেছি।”
বলির অর্থের কথা আলোচনা না করিয়া নগেন বলিলেন–“আচ্ছা, এই পর্বের আর এক নাম বুঝি বকুরিদ? বরি না কেটে আপনারা গরু কেন কাটেন?”
রায়হান কহিলেন–“গরু জবেহ অথবা কোরবানি করা হয়। গরু কাটা হয় বলতে নাই। বকর আরবি কথা। শব্দটির অর্থ ছাগ নহে।”
নগেন একটু রুষ্ট হইয়া বলিলেন–“গরু কোরবানি করে হিন্দুদের মনে ব্যথা দেবার দরকার কী?”
এই সমস্ত আলোচনার জন্য রায়হান প্রস্তুত ছিলেন না। বিস্ময়ে রায়হান বলিলেন–“আপনারা তো আর কোরবানি করেন না। গো উৎসর্গে যদি পাপ হয়–তবে সে আমাদেরই হয়। গরুর মৃত্যু দেখে বিরক্ত হন! আমরা আপনাদের প্রতিমা দেখে যথেষ্ট বিরক্ত হতে পারি। মুসলমানের বিশ্বাস প্রতিমা পূজায় মানুষের আত্মা দৃষ্টিহীন হয় এবং মৃত্যু লাভ করে। চোখের সামনে মানুষের এই মৃত্যু মুসলমানকে দিবারাত্রি দেখতে হয়। মানুষকে মৃত্যু ও কুসংস্কার হতে বাঁচাবার জন্য মুসলমানের অস্তিত্ব। প্রতিমা পূজায় তার জীবনকে মিথ্যা করে দেওয়া হয়, তবুও সে অধীর-অত্যাচারী হয় না।”
একটু নীরব থাকিয়া রায়হান কঠিন স্বরে কহিলেন–“বড় বড় শহরে গো-হত্যা হয় তাতে কিছু বলা হয় না–পল্লীর নির্জন কুটির পার্শ্বে মুসলমান বাদ্য না বাজিয়ে নীরবে ধর্ম পালন করে তা ভেবে আপনাদের দরকার কী? গরু তো প্রাচীনকালে হিন্দুরাও খেতেন। গরু খাওযা শরীরের দিক দিয়া ক্ষতিজনক কিংবা পার্থিব কোনো স্বার্থসিদ্ধির অন্তরায় এর ভিতরে যদি কিছু সত্য থাকে তবে তাহা ধীরভাবে সকলের মাঝে প্রচার করলেই তো হয়। জোর করে মানুষের দ্বারা কি কোনো কাজ করান যায়?”
বিরক্তির সহিত রায়হান আবার বলিলেন–“কাহারও ধর্মকার্যে বাধা দেওয়া একেবারে অযৌক্তিক। একে অন্যের দাবি স্বীকার করি না বলেই ইংরেজ জাতিকে মধ্যস্থ মানতে হয়েছে।”
নগেন দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন–“হুঁ।”
.
ত্রয়ত্রিংশ পরিচ্ছেদ
ঈদের নামাজ পড়িয়া রায়হান মুরব্বীদিগকে যথারীতি সম্মান জানাইয়া যখন আমেনাকে দেখিতে গেলেন, তখন আমেনার সঙ্গে তাহার স্বামী হামিদও রায়হানের পদচুম্বন করিল।
রায়হান বাধা দিয়া হামিদের হাত ধরিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন–“পাগল নাকি? এসব পুরোনো দস্তুর আমি ভালবাসি না।”
হামিদ হাসিয়া বলিলেন–“স্ত্রীর ওস্তাদ। যার কৃপায় এই রহলাভ করেছি তাকে সম্মান জানাব না?”
রায়হান উপবেশন করিয়া বলিলেন–“পদচুম্বন করা জঘন্য ব্যাপার। মানুষের ব্যক্তিত্বের উপর অত্যাচার আমি পছন্দ করি না।”
আমেনা কহিলেন–“মায়ের কাছে যেতে পাল্লাম না। মনে কষ্ট হচ্ছে। হয়তো মা কত ব্যথা পাচ্ছে।”
রায়হান বলিলেন–“এ কোনো কথা নয়। তোমার সুখেই তোমার মার সুখ। তাঁর কি স্বতন্ত্র সুখ আছে? তোমার মা সাধারণ শ্রেণীর স্ত্রীলোক নন। ঈদের দিন মায়ের কাছে না যেয়ে যে স্বামীর সুখ বর্ধন করতে ব্যস্ত আছ এতেই তার সুখ।”
একটা লোক আসিয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে সংবাদ দিল–“কোরবানি নিয়ে হিন্দু মুসলমানে দাঙ্গা বেধেছে। আপনারা আসুন।”
সহসা রায়হানের মুখ কাল হইয়া উঠিল। মৃদুস্বরে তিনি কহিলেন–“হিন্দু মুসলমানের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আমাদের দুই জাতির কী হবে বলতে পারি না।”
হামিদ–হিন্দুর উপর বিশ্বাস আমি হারাচ্ছি। একটা মহাজাতির বিশ্বাস ও দাবিকে উড়িয়ে দেবার কী উৎকট আয়োজন!”
উভয়ে বিলম্ব করা সমীচীন নহে ভাবিয়া তৎক্ষণাৎ ঘটনাস্থলাভিমুখে রওয়ানা হইলেন। হামিদ বলিলেন–“হিন্দুদের এই অন্যায় প্রতিবাদের কথা আগে যদি জানা যেতো তা হলে আইনের সাহায্যে তাহাদের দাম্ভিকতা অনেকটা রোধ করা যেতো। কী বিচিত্র! এতদিন তাদের ধর্মভাবের উদ্রেক হয় নাই!”
দূর হইতেই শোরগোল শোনা যাইতেছিল। রায়হান কথা কহিলেন না। দক্ষিণ হস্তে বুকখানি চাপিয়া ধরিয়া দ্রুত চলিতে লাগিলেন।
পল্লীর দক্ষিণপ্রান্তে একটা ছোট মাঠে উত্তেজিত হিন্দু-মুসলমান ভীষণভাবে এ উহাকে আক্রমণ করিতেছিল।