করিমা মনে মনে নিজকে প্রশ্ন করিল–জীবনের উদ্দেশ্য কী? কোথায় মানুষের শেষ? কোনোদিকে মানুষের গতি?
করিমা ভাবিল–জীবন কি হাহাকারময়? কোথায় মানুষের শান্তি? আকাশে-বাতাসে দুপুরে-নিশীথে কেবল বেদনার প্রতিধ্বনি উঠে।
সে আরও ভাবিল–এই পৃথিবীতে কত অন্তহীন নরনারী! সৃষ্টির প্রথম হইতে অনন্ত মানুষের ধারা বহিয়া চলিয়াছে–অনন্ত যুবক-যুবতী প্রেম ও হাসির আনন্দে বাঁচিয়া থাকে–তার পর তারা চলিয়া যায়।
তার মনে হইল–মানুষের দুঃখ অন্যায় ও অজ্ঞানতায়। করিমা আবার ভাবিল–অন্যায় করিয়া মানুষ কী করিয়া বাঁচে? মানুষে মানুষে পার্থক্য কী? একটা মানুষের বেদনা আর একটা মানুষের মনে সমানভাবে বাজে না কেন?–মানুষের সুখ কোথায়? কেমন করিয়া এই লক্ষ্য মানুষকে সুখী করা যায়?
মানুষ কেন পাপ করে? পাপে মানুষ কেমন করিয়া শান্তি পায়? পরকে আঘাত করে কেমন করিয়া মানুষ কাল কাটায়? কেমন করিয়া সে হাসে? কী বিস্ময়!
কত জননীর বুক ভাঙ্গিয়া অনন্ত শিশু আকাশে বাতাসে মিশিয়া আছে। কত প্রেমিক প্রেমিকা কোনো অনন্তে ভাসিয়া চলিয়া গিয়াছে।
তার মনে হইল–মানুষের সুখ কেবল পুণ্যে ও জ্ঞানে। করিমা আবার ভাবিল–এই ভীম প্রকৃতির মাঝখানে দাঁড়াইয়া মানুষ তার দীনতা বুঝুক। আত্মা তার গোপন কথার সাহিত পরিচিত হউক।
উদ্দাম বাতাস অবগুণ্ঠিতা করিমার চোখে-মুখে আসিয়া লাগিতে ছিল। অসংযত অঞ্চলখানি করিমা গায়ের সঙ্গে আঁটিয়া লইল।
দূর পূর্ব-আকাশের মেঘগুলি হিমশীতল বাতাসের সহিত যুঝিয়া যুঝিয়া সরিয়া যাইতেছিল। এই উদ্দাম ও ভয়াবহ প্রকৃতির চাঞ্চল্য করিমার কানের কাছে কি যেন বলিয়া যায়–কাহার সন্ধান যেন দিয়া যায়। তার মন যেন কেমন হইয়া উঠে। একটা দারুণ সীমাহীন হাহাকার ও বেদনা তার মনকে বিব্রত করিয়া তুলে। সে খানিক কাঁদিতে চায়। মৃত্যুর ভিতর দিয়া সে এক তৃপ্তির রাজ্যে চলিয়া যাইতে ইচ্ছা করে। ঊর্ধ্বে আরো সে চায় মহাকাশে বিদ্যুতের মতো সে ছুটিয়া খেলিয়া বেড়ায়।
সন্ধ্যার ছায়া করিমার চক্ষদ্বয়কে আরও ছায়াময় করিয়া তুলিল। করিমা ছাদ হইতে ধীরে ধীরে নিচে নামিল।
.
সেদিন বাতাসের বিরাম ছিল না। শেষ রাত্রে করিমা বাহিরে উঠানে আসিয়া দাঁড়াইল। তখন মেঘের অন্তরালে তারাগুলি অস্পষ্ট হইয়া জ্বলিতেছিল।
বাতাস সুপ্ত পৃথিবীকে যেন মথিত করিয়া দিতেছিল।
করিমা ধীরে ধীরে ছাদের উপর উঠিল। অমলিন মেঘের ভিতর দিয়া শেষরাত্রের স্নান আলো ফুটিয়া উঠিয়াছিল। অস্পষ্ট আলোস্তরের উপর দিয়া করিমা দূর প্রান্তরেখার দিকে চাহিয়া রহিল।
মেঘগুলি ধীরে ধীরে আবার জমাট বাঁধিতেছিল?
অব্যক্ত বেদনায় করিমার আত্মাখানি কাঁদিতে লাগিল। তার মনে হইতেছিল, কিছু না, এ পৃথিবীর সবই নশ্বর! মন তাহার এই প্রকৃতির উন্মাদনার ভিতর দিয়া কাহার পানে ছুটিতে লাগিল। কোথায় তিনি?
আকাশ হইতে বৃষ্টি ঝরিতেছিল। করিমা ধীরে ধীরে অগ্রসর হইতে লাগিল। বেশি দূর নহে। বাম পার্শ্বে রায়াহনের দোকান।
করিমা দোকান-ঘরের সম্মুখে যাইয়া দাঁড়াইল। পাথরের মূর্তির মতো বৃষ্টি ও বাতাসের মধ্যে প্রায় অর্ধঘণ্টা করিমা দাঁড়াইয়া রহিল।
অস্ফুট মৃদুস্বরে কপালে হাত উঠাইয়া করুণ বেদনায় বলিয়া উঠিল–ওগো প্রিয়তম–তোমায় সালাম! তাহার পর সে ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে ফিরিয়া গেল।
.
দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ
দিল্লী হইতে একখণ্ড পত্র পাইয়া রায়হান দুঃখ ও বেদানয় একেবারে নুইয়া পড়িলেন। পত্র পড়িয়া রায়হান অরোধ করিতে পারিলেন না।
এখখানা মানি অর্ডারের ফরম ভর্তি করিয়া রায়হান তখনই দিল্লীর ঠিকানায় একখানা দীর্ঘ পত্র লিখিলেন। পত্রখানি এই রূপ।
ওদেমপুর
প্রিয় দিদি,
তোমার পত্র আমাকে স্তম্ভিত করিয়া দিয়াছে। হর্ষ ও বিষাদ চিত্ত গভীরভাবে স্পর্শ। করিয়াছে। যাহা আশা করি নাই, যাহা ভাবিতেও শিহরিয়া উঠি তাহা প্রত্যক্ষ করিলাম।
এই করুণ ও দুঃখ পূর্ণ ঘটনায় কী লিখিব, কী কহিব, কিছুই বুঝিতেছি না।
আমি আসিতেছি–খবর যখন দিয়াছ তখন আর ভয় নাই। প্রথমে যদি আমাকে তোমার সন্ধান জানিবার সুযোগ দিতে তাহা হইলে এত বিভ্রাট ও লাঞ্ছনার মধ্যে পড়িতে না। ব্যথিতের সেবায় শেষ কপর্দক পর্যন্ত ব্যয় করা আমার জীবনের উদ্দেশ্য। জাতি তোমার যায় নাই। যারা তোমার উপর অত্যাচার করিয়াছে–তাহাদের জাতি গিয়াছে। কুড়িটি টাকা পাঠাইলাম।
রায়হান তখনই পত্রখানি হাতে লইয়া ডাকঘরের দিকে গেলেন।
পত্র ডাকে দিয়া ফিরিয়া আসিবার সময় পথে তাহার দেখা হইল নগেন ঘোষের সহিত।
রায়হান সাদরে জিজ্ঞাসা করিলেন–“কি খুড়ো, কোথায় গিয়েছিলেন?
নগেন আগ্রহে বলিলেন–“এই যে বাবা রায়হান, আপনাকেই খুঁজছি–একটি বিশেষ কথা। তিলিপাড়া হয়ে আসছি।”
রায়হান বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিলেন–“কি কথা খুড়ো?” পার্শ্বে ছায়াময় বৃক্ষতলার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া নগেন কহিলেন–“তা হলে এই গাছতলায় একটু বসা যাক”।
রায়হান দ্বিরুক্তি না করিয়া নগেনের সহিত গাছের নিচে দূর্বার উপর উপবেশন করিলেন।
অনেকক্ষণ নিস্তদ্ধ থাকিয়ে নগেন কহিলেন–“আপনি সাধারণ মুসলমান নন! গ্রামের মধ্যে আপনি একজন ভদ্রলোক, তাই বলতে সাহস করছি।”
রায়হান বলিলেন–“মুসলমানের আবার সাধারণ অসাধারণ কী? সব মুসলমানই ভাই ভাই। গ্রামের মধ্যে শুধু আমিই কি ভদ্রলোক?”