আমেনা রায়হানকে কহিল–“ওস্তাদ সাহেব, এ-সব কী শুনছি?”
রায়াহন–“কোন্ সম্বন্ধে কথা বলছো?”
“আমার বেয়াদবি মাফ করবেন, জীবনে আপনাকে যতটা আপনার মনে করি এমন আর কাউকে মনে করি না। আমার বিশ্বাস আমার মনের কথা আপনাকে বল্লে আপনি আমাকে আরও অধিক করে ভালো জানবেন।”
“নিশ্চয়ই–আমি তোমার ওস্তাদ নই,আমি তোমার শ্রদ্ধেয় বন্ধু। কী কথা? নির্ভয়ে বলো!”
“আমার যেন কেমন বোধ হয়। এতকাল পরে আমি লজ্জাহীন ও ছোট বলিয়া প্রতিপন্ন হব। মনের ভাব ব্যক্ত করতে অনুমতি চাই।”
“তুমি কি কখনো আমার কাছে কোনো কথা বলতে সঙ্কোচ বোধ করেছ? ওস্তাদের কাছে কোনো কথা গোপন রাখতে নাই।”
“একটা অতীত কথা যা অত্যন্ত বেদনাব্যঞ্জক। আপনার নিকট হতে গোপন করে রেখেছি। সে অনেক দিন আগেকার কথা। সে কথা বলতে আমি পারি না। বর্তমানে একটা নূতন কথা এসে জুটেছে তাই বলতে চাই।”
“আচ্ছা, এখনকার যে কথা তাই বল।”
“আমাকে বিবাহ দিবার জন্য মা পীড়াপীড়ি কচ্ছেন। জিজ্ঞাসা করি, কে কে এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছেন? এই সমস্ত কথা মাকে জিজ্ঞাসা করতে সঙ্কোচ বোধ করি। আপনাকেও জিজ্ঞাসা করতাম না যদি আপনি অন্য কেউ হতেন।”
“আমেনা আমার প্রিয় শিষ্যা! এ কি তুমি অন্যায় মনে কর?”
“আপনি আমার ওস্তাদ। কেমন করে বলবো!”
“করি–খুবই অন্যায় মনে করি,–যিনি এই কার্যে লিপ্ত হবেন তিনি আমার মনের উপর খুবই অত্যাচার করবেন। তিনি অত্যাচারী, আমার কেউ নয়।”
“সে যদি অত্যাচারী হয় তবে সে আমি।”
আমেনার চোখ জলে ভরিয়া উঠিল। মুখ ফিরাইয়া কাপড়ে চোখ ঢাকিয়া আর্তকণ্ঠে সে কহিল–“গুরু গুরু, আমায় ক্ষমা করুন, আমায় অভয় দিন, বলিব কী? আমি যে ছাত্রী, আপনি যে আমার গুরু!”
রায়হান সংযতকণ্ঠে কহিলেন–“বল।”
আমেনা দুই হাত এক সঙ্গে তুলিয়া ঊর্ধ্ব দিকে চাহিয়া বলিল–“এমন কোনো কথা নাই যা ওস্তাদের কাছে বলা যায় না।”
আমেনার চক্ষু ঊর্ধ্ব দিকেই নিবদ্ধ রহিল। হাত দুখানি মাটির উপর নামাইয়া দিয়া সম্মুখদিকে একটু নত হইয়া শীতল রক্তহীন মুখে সে কহিল–ওগো গুরু, ওগো ওস্তাদ! তখনও আমার বিবাহ হয় নাই যখন আপনার পায়ে নিজের সবকিছু সুখ-দুঃখ রেখেছিলাম। একবারও কেউ আমায় জিজ্ঞাসা করলে না। আমার জীবন ও আত্মার গুরু আপনি আমার সুখ ও দুঃখে আপনার অনুভূতি আছে। একবার ভুল হয়েছে, আর যেন না হয়। আমি অবিবাহিতা থাকব।”
মুহূর্তে রায়হানের সম্মুখে একটা নূতন পৃথিবী ভাসিয়া উঠিল। যে কথা আমেনা কোনোকালে প্রকাশ করিতে চাহিয়াছিল না, কথা প্রসঙ্গে তাহা বলিয়া ফেলিয়া সে রায়হানকে স্তব্ধ করিয়া দিল। রায়হান বিচলিত হইয়া পড়িলেন। নিজকে সহজ ও স্বাভাবিক করিয়া রায়হান ধীর সংযত কণ্ঠে বলিলেন,–“প্রিয় আমেনা তুমি ভিতরে ভিতরে এতকিছু করে বসে আছে। তোমার সঙ্গে আমার কি সম্বন্ধ তা জান?”
“জানি, ভালো করে জানতাম ও জানি।”
রায়হানের দুই চক্ষু জলে ভরিয়া উঠিল। আর্দ্র কণ্ঠে রায়হান কহিলেন–“শিশু তুমি, বুঝে নিজেকে এত প্রশ্রয় দিয়েছ। ওস্তাদের প্রতি তোমার শ্রদ্ধা গভীর নহে বুঝলাম। কই, একদিনও তো তুমি আমায় জিজ্ঞাসা করো নাই?”
আমেনা কুণ্ঠায় কহিল–“জিজ্ঞাসা করি নাই”
”এমন কিছু নাই যা গুরুর কাছে জিজ্ঞাসা না করা যায়।”
“আমার অপরাধ হয়েছে?”
রায়হান বলিলন–“হ্যাঁ, তোমার অপরাধ হয়েছে।”
আমার ভুল ও সত্য আপনার কাছে নিবেদন করলাম–আপনার আজ্ঞা মাথায় পেতে নেবো। শাস্তি যদি দিতে হয় দিন।”
“তা হলে তুমি আমার যথার্থ ছাত্রী। হৃদয়ে অসীম আনন্দ লাভ করলাম।“ রায়হান দৃঢ়কণ্ঠে বলিলেন–“আমার আজ্ঞা মাথায় পেতে নেবে?”
আমেনা উঠিয়া দাঁড়াইয়া সহজভাবে কহিল–“আমার গুরু ভক্তি মিথ্যা নহে।”
“ভালো তাহলে তোমায় বিবাহ করতেই হবে। কোনো কথা বলতে পারবে না। কিছু ভাবতে পারবে না।”
“প্রতিজ্ঞা করলাম তাই করবো–কিন্তু একটা কথা; প্রতিবাদ নয়।”
“বল।”
একবার তো বিবাহ হয়েছিল–আর কেন? মা কি আমায় ভার মনে করেছেন? তাহলে আমি আপনার কাছে যাই। জীবন সেবার দ্বারা কাটিয়ে দেব। তাতেই চিত্তে সুখ ও সান্ত্বনা আসবে। বিশ্বে আমার কোথাও শান্তি নাই। আপনি ছাড়া কেউ আমায় চেনে না।
“আবদুল হামিদ শিক্ষিত যুবক। আত্মা তার অন্ধ নহে। সেখানে অত্যাচার ও অসম্মানের কোনো ভয় নাই। সে তোমায় চিনবে–তোমার মনে সেখানে মর্যাদা হবে।”
ওড়নার আঁচল ধরিয়া আমেনা দেয়ালে মক্কা শরীফের ছবির দিকে চাহিয়া বলিল–“আপনার আজ্ঞা এই”?
“হ্যাঁ।”
পায়ের দিকে মুখ করিয়া অনেকক্ষণ নীরব থাকিয়া আমেনা মৃদু স্বরে কহিল”এক মুহূর্তও ভাবতে দেবেন না? আপনার আজ্ঞা যেন আশীর্বাদ রূপে গ্রহণ করতে পারি।”
৩১-৩৫. আকাশে মেঘ করিয়াছে
একত্রিংশ পরিচ্ছেদ
আকাশে মেঘ করিয়াছে। নিবিড় ঘনকৃষ্ণ মেঘের স্তর সারা আকাশ ছাইয়া ফেলিয়াছিল।
করিমা ছাদের উপর দাঁড়াইয়া একাকী আকাশের দিকে চাহিয়া মেঘের খেলা দেখিতেছিল। ঝটিকা-প্রবাহ মেঘগুলিকে ছিন্নভিন্ন করিয়া দিতেছিল।
দিবসের আলো ম্লান হইয়া আসিল। করিমা দেখিল–আকাশের বিরাট গম্ভীর মূর্তি বজ ও বিদ্যুতের লীলা। তার মনে হইল–জীবন যেন কিছু নয়। মানুষের সম্মুখে কি ভয়ানক পরীক্ষা! এই জড়দেহ চূর্ণ হইলে কী ক্ষতি! আত্মা, প্রেম ও মহত্ত্বের সহিত মিলাইয়া দেওয়াই ঠিক।