খোরশেদ বিরক্ত হইয়া কহিল–“তুমি অন্ধ। খোদা তোমাকে নরকগামী করবেন।”
একজন ঠাকুর বলিলেন–“হিন্দু ধর্ম, মুসলমান ধর্ম–সবই এক, রাম রহিমে কোনো পার্থক্য নাই।”
খোরশেদ গম্ভীরভাবে কহিল–“কাফের ছাড়া অন্য কেহ এ কথা বলতে সাহস পায়।” রাত্রি ১০টা পর্যন্ত সে যাত্রীদের সহিত পীরের মতো বহু বচসা করিল।
যখন দেরাজপুর স্টেশনে ট্রেন থামিল তখন রাত্রি এগারটা। খোরশেদের গাড়িখানি। তখন প্রায় খালি। সে বিছানা পাতিয়া শুইবার চেষ্টা করিতেছিল। এমন সময় একটা যুবতী পার্শ্ব-প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করিল। বাম হস্তে একটা ক্যাশবাক্স, দক্ষিণ হস্তে একটা টিফিন বাক্স লইয়া যুবতীর সঙ্গে একটা বৃদ্ধ উঠিল।
যুবতী কহিল–“কলিকাতা হতে রামগড় একেবারে কম দূর নয়। রোজার সময় আরও বেশি কষ্ট হয়।”
খোরশেদ কৌতূহলপর হইয়া জিজ্ঞাসা করিল–“তোমরা কোথায় যাবে?”
বৃদ্ধা কহিল–“আপনার বেশ দেখে মনে হচ্ছে আপনি সংসারবিরাগী পুরুষ। তাড়াতাড়িতে পুরুষের গাড়িতে উঠে পড়েছি। রোজার মাসে আপনার ন্যায় ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হওয়া আমাদের নসিবে ছিল।”
পীর সাহেব কহিলেন–“তোমার মুনিব কোন গাড়িতে আছেন, দেখে উঠিয়ে দিয়ে গেলেই তো ভালো হতো।”
যুবতী নম্রভাবে অথচ লজ্জাহীনার মতো কহিল–“মৌলানা সাহেব, আমাদের কোনো মুনিব নাই। আপনি পবিত্র পুরুষ, আমাদের সঙ্গে কথা বল্লে আপনার পাপ হতে পারে। আমরা পতিতা।”
খোরশেদ বিছানা হইতে উঠিয়া বিস্ময়ে কহিল–“তোমরা পতিতা! মুখে রমজান মাসের মহিমা কীর্তন, এ তো কোনোকালে শুনি নি?”
যুবতী বলিল–“দয়া করে যখন কথা বলেছেন তখন উত্তর করলে খোদার কাছে পাপী হবো না।”
খোরশেদ অধিকতর বিস্ময়ে বাধা দিয়া কহিল–“তোমরা মুসলমান?”
যুবতী কহিল–“হ্যাঁ হুজুর, আমরা মুসলমান।”
খোরশেদ অবাক হইয়া গেল। বক্ষ তার অপরিসীম অকৃত্রিম দুঃখে ভাসিয়া যাইতেছিল। অস্পষ্ট বেদনা-ভরা স্বরে সে বলিয়া উঠিল–“ইসলামের প্রতি এই অবমাননা? ইসলাম তো নারীকে যথেষ্ট সুবিধা দিয়াছে। তবে এ পিপ কেন?”
খোরশেদ আর কোনো কথা কহিল না।
রাত্রি যখন দুইটা তখন বৃদ্ধা ও যুবতী পর দিবসের রোজার জন্য কিছু খাইয়া লইল। খোরশেদ সবই দেখিল।
০ ০ ০ ০
গন্তব্যস্থানে যাইবার আর বেশি দেরি ছিল না। স্টেশন হইতে নামিয়া সোজাসুজি থানায় যাইয়া যাহা করিবার তাহা করিতে হইবে।
খোরশেদ একটা চুরুট ধরাইয়া শেষ রাত্রের আমোদকে আরও বাড়াইয়া তুলিতেছিল, আর ভাবিতেছিল, ইসলামের মধ্যে পতিতা।
সহসা যুবতী জিজ্ঞাসা করিল–“হুজুর, একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই। আমার ভুল হতে পারে।”
খোরশেদ কহিল,–“বল।”
যুবতী বলিল–“কয়েক বৎসর আগে রামপুর জেলার মহেন্দ্রনগরের থানায় ঠিক আপনার মতো দেখতে এক দারোগা ছিলেন। তিনি মুসলমানকে বড় ভালবাসতেন। সে বড় দুঃখের কথা। আমি তাকে পিতা বলে জানতাম। আকৃতির এমন আশ্চর্য সাদৃশ্য আর কোথাও দেখি নাই।”
খোরশেদ বলিয়া উঠিল–“আমিই সেই দারোগা।”
যুবতী সহসা আকুল আবেগে উন্মাদিনীর মতো খোরশেদের পা জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিয়া উঠিল।
খোরশেদের মাথার ভিতর সহসা একটা অস্পষ্ট স্মৃতি জাগিয়া উঠিল। সে বিস্মিত সহানুভূতিতে কহিল–“কি কথা, খুলে বল দেখি বাপু।”
যুবতী বলিল, “আমি আজিজ মিঞার বৌ।” খোরশেদ সহসা একটা দারুণ অস্বচ্ছন্দতায় গাড়ির বেড়ার উপর পড়িয়া গেল।
যে রাত্রে আজিজ-পত্নী থানায় খোরশেদের সহিত দেখা করে, জমিদারদের প্ররোচনায় বরকন্দাজদের সাহায্যে সেই রাত্রেই তাহাকে সরাইয়া ফেলা হয়। এই কাজটা গোপনেই সিদ্ধ হইয়াছিল। ফলে জমিদারেরা নিষ্কণ্টক হইতে পারিয়াছিল।
খোরশেদ একটু প্রকৃতিস্থ হইয়া যুবতাঁকে জিজ্ঞাসা করিল, “তাহলে কী করা যায়?”
যুবতী কহিল–“আপনি আমার পিতা। পিতার সঙ্গে পথের মাঝে দেখা হয়েছে, আর আমি আপনাকে ছাড়বো না। আমাকে রক্ষা করবেন। আমার গত সম্মান ফিরিয়ে দেবেন। তা হলেই আমি মানুষের মাঝে মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে সাহস পাবো।”
খোরশেদ আগ্রহে কহিল–“তাহলে আর দেরি করে দরকার নেই তোমার সঙ্গে যে সব জিনিস আছে, এগুলি বাইরে ফেলে দাও। আমি আর টাউনে নামবো না, তোমায় নিয়ে। একেবারে দেশে যাবো। তোমার ভয় নাই, কোনো কথা আমা হতে প্রকাশ হবে না। আমাদের গ্রামে একটা শিল্প-বিদ্যালয় আছে, সেখানে বহু মেয়ে পড়ে এবং কাজ শেখে। তোমার সব খরচ আপাতত আমি বহন করবো। সেখানে কাজ শিখে সংসারে তুমি স্থান। করে নিতে পারবে।”
অসময়ে রায়হান সন্ধ্যাকালে একখানা পাল্কিসহ খোরশেদকে উপস্থিত হইতে দেখিয়া –বিস্মিত না হইয়া পারিলেন না। খোরশেদকে সম্ভাষণ জানাইয়া সহসা একটা কথা মনে করিয়া রায়হান উত্তেজিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন–“খোরশেদ গিরিকে পেয়েছ?”
খোরশেদ স্থিরভাবে কহিল–“না।”
ক্লান্ত খোরশেদ মাটির উপর বসিয়া পড়িয়া কহিল–“রায়হান ভাই, একটু বসতে চাই, কিছু থাকলে এনে দাও; আমাকে এখনই ফিরতে হবে! নইলে ডিসমিস্ হবার সম্ভাবনা।”
ঘরের ভিতরে চেয়ারখানি টানিয়া দিয়া রায়হান বলিলেন–“বল কী? বাড়ি যাবে না? গুরুতর কিছু হয়েছে নাকি? পাল্কির ভেতর ইনি কে? এ তাড়াতাড়ির অর্থ কী?”
খোরশেদ কহিল–“এর জন্য আমি এসেছি। এর কেউ নেই। তোমার স্কুলের ইনি একজন ছাত্রী।”
.
ত্রিংশ পরিচ্ছেদ