আবেগমাখা কণ্ঠে গিরি কহিল–“আমার বাল্যজীবনে হাসি-খেলার মতো তুমি এত বড় ভুলের দাগ কেটে দিয়েছিলে!”
আড়ষ্ঠ কণ্ঠ বাম হস্তে চাপিয়া ধরিয়া গিরি মাটির দিকে নত হইয়া কহিল–“ভগবান! আমার কী হবে” তাহার সমস্ত মুখখানি রক্তহীন কাগজের মতো হইয়া গেল। সম্মুখে প্রদীপের উজ্জ্বল আলোকে খোরশেদ ঠিক তেমনি ভাবে দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার মানসিক ভাব তলাইয়া দেখিতে গিরি সাহস পাইল না।
খোরশেদ কহিল–কে তোমাকে এখানে আসতে বলেছে?
”আমার বিশ্বাস!”
“তোমার বিশ্বাস তোমাকে ভুল পথে টেনে এনেছে। তোমার সহিত ঠাট্টা ছাড়া আর কিছু করি নাই। গুরুতর ক্ষতি করা ছাড়া আমা: আর কোনো উদ্দেশ্যে ছিল না।” অনেকক্ষণ উভয়েই স্তব্ধ হইয়া রহিল। খোরশেদ সহজ কণ্ঠে কহিল–“তুমি আমাকে ভালবাস?”
“এখন বাসিতেছি। এখন তাতে কোনো ময়লা নাই। আগে ভীত হয়েছিলাম।”
“কারণ?”
“বাপ-মা মরে গেছেন। পরের কৃপার পাত্র হয়ে থাকতে হচ্ছিলো। তুমি তা জান। পরের বাড়ির বেদনা, অসম্মান ও ঔদাসীন্য আমাকে ভেঙ্গে ফেলেছে। তুমি অনেক কথাই জান।”
“জানি।”
নারীর স্বভাব আমাকে জানিয়ে দিয়েছে–“হিন্দু ধর্ম নারীর জন্য নয়। আমি মুসলমান হতে চাই। তুমি আমার আশ্রয় ও অবলম্বন।”
খোরশেদ বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল–“ধর্ম পরিত্যাগ করতে চাও! তোমার সমাজে কু-সংস্কার ঢুকেছে তাই বলে কী তোমার ধর্ম মিথ্যা!”
“তা হলে হিন্দু হয়েই তোমায় আমি মেনে নিলাম?”
“মুসলমানের পক্ষে হিন্দুকে বিবাহ করা লজ্জাজনক। সমাজে আমার স্থান হবে না।”
“বাইরে মুসলমান হলেও ভিতরে ভিতরে হিন্দু থাকবো।”
“সেটা পাপ।”
“তা হলে আমি মুসলমান হব।”
“কোন্ বিশ্বাসে?”
“যে ধর্মে মানুষকে এমন করে হত্যা করবার অবাধ বিধান আছে, সে ধর্মে আমি কিছুতেই থাকতে চাই না। হিন্দুর নির্মম অত্যাচারে শত শত নারী পথে বেরিয়েছে।” গিরি আবেগে কাঁদিয়া কহিল–“ওগো, আমায় রক্ষা করে। হিন্দু ধর্মে মানুষ আর বেঁচে থাকতে পারে না। মুসলমান ধর্মে নতুন কিছু বিধান নাই। হিন্দুর লক্ষ্য ঈশ্বর, মহামানুষ মোহাম্মদের মহামানবতাকে স্বীকার করলে তার ক্ষতি হবে না। হিন্দু যদি মুসলমান হয় তা হলে তার। পতন হবে না।”
খোরশেদ সহজ স্পষ্ট স্বরে কহিল–“গিরি ক্ষমা কর। তোমাকে ঘরে স্থান দিলে আমার কলঙ্ক হবে। তুমি চলে যাও। মুসলমান হলেও তুমি হিন্দু। ছেলেমেয়ে তাদের সঙ্গে সামজ-সম্বন্ধ করতে ঘৃণা বোধ করবে। দেশময় কলঙ্ক হবে। যাও দেরি করো না।”
গিরির বুকের ভিতর কে যেন আগুন জ্বালিয়ে দিল। তাহার ইচ্ছা হইল সে তাহার দেহটাকে কাটিয়া ছিন্ন ভিন্ন করিয়া ফেলে। সে তাহার অবস্থার কথা ভাবিয়া শিহরিয়া উঠিল। তাহার আরও ইচ্ছা হইল, এই পৃথিবীটাকে সে চূর্ণ করিয়া ফেলে। মিথ্যা শাসন, মিথ্যা বিধানকে দলিয়া দেয়।
সহসা গত জীবনের সোনালি স্বপ্নকে ফিরাইয়া আনিয়া সে কহিল–“খোরশেদ! তুমি যদি আমায় ভালবাস, তাহলে পৃথিবী তোমার ও আমার কাছে সুন্দর হয়ে উঠবে। তোমার প্রতারণার কথা ভুলে যাও।”
খোরশেদ নিষ্ঠুরভাবে কহিল–“আমি তোমায় ভালবাসতে পারি না।”
“আমি হিন্দু, তাই ভালবাসতে ভয় পাও? কিন্তু জেনো, আমার ভিতরে এমন কিছু আছে যা সারা ত্রিভুবন খুঁজেও তুমি পাবে না।”
“প্রেমের জন্য যে ধর্ম পরিত্যাগ করতে চায় সে নরাধম। ইসলামের তুমি কি দেখেছ?”
“স্বীকার করি। খোরশেদ ক্ষমা করো। তুমি জানো–কেউ আমার নাই; সংসারের উপর একটা ভার ছাড়া আর কিছু নই। প্রথম জীবনে আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছিলাম–বোধ হয় বিবাহের জন্য নয়। মানুষের স্বভাবকে যে ধর্ম অস্বীকার করে সে ধর্ম ধর্মই নয়! তাই তোমার হাত ধরতে চাই। পর হয়েও কি তোমার কাছে থাকতে পারবো না?”
খোরশেদ কিছুমাত্র বিচলিত না হইয়া কহিল–“যেভাবে তুমি থাকতে চাও, সেটাও আপত্তিজনক। মুসলমান হলেও তোমায় আমি এভাবে আপন বলে স্বীকার করতে পারতাম না। তুমি যাও, তোমাকে যেতে হবে। থানার লোকে জানতে পারলে একটা অসন্তোষ সৃষ্টি হবে। ঊষার অনেক আগে তুমি চলে যাও। আমার চাকরি নষ্ট করো না”।
“যখন এসেছি তখন আর আমি কোথায় যাব? জাতি আমার নাই, জাত থাকলেও অবশ্য কোনো লাভ ছিল না। আবার বলি পরের মতো, বোনের মতো, অতিথি হয়েও কি তোমার কাছে থাকতে পারবো না? পৃথিবীর সব দুয়ারই কি আমার সম্মুখে রুদ্ধ হয়ে যাবে?”
খোরশেদ–“তা তো আপত্তিজনক।”
গিরি আর কিছু কহিল না–বিদায় প্রার্থনা করিল না। মৌন-নির্বাক হইয়া সে বাসা ঘরের উঠান অতিক্রম করিয়া পথে আসিয়া দাঁড়াইল।
.
উনত্রিংশ পরিচ্ছেদ
রোজার মাসে খোরশেদের উচ্ছলতা অনেকটা কমিয়া গিয়াছে। সে অনেকটা সংযমী হইয়াছে।
।একটা বহুদিনের পুরানো ডাকাত সম্প্রতি রামগড় অঞ্চলে কোনো দুরভিসন্ধিতে গিয়াছে। এই সংবাদ পাইয়া খোরশেদ ছদ্মবেশে ট্রেন চড়িয়াছিল। পায়ে একজোড়া পামসু, পরনে পাজামা গায়ে মলমলের পিরহান, মাথায় একটা কিস্তি টুপি, হাতে বিলেতি ব্যাগ।
তাহাকে একজন পীরসাহেব বলিয়া মনে হইতেছিল। গাড়ির ভিতর অনেকে তাহার সঙ্গলাভের জন্য ব্যস্ত হইল। অনেক যুবক বৃদ্ধ তাহার পদধূলি গ্রহণ করিল।
খোরশেদ গম্ভীরভাবে সকলের কাছে স্বীয় ধর্মের মহিমা কীর্তন করিতেছিল। একজন, খ্রিস্টান সেখানে বসিয়াছিল। সে কহিল–“পীর সাহেব, ধর্ম সম্বন্ধে যাই বলেন, খ্রিস্টান ধর্মের মতো ধর্ম নাই। আপনি এবং আপনার শিষ্যবর্গ অন্ধকারে পড়ে আছেন। আমরা আলোক রাজ্যের সন্ধান পেয়েছি।”