বেলা হইয়া গিয়াছিল বলিয়া আবুল হোসেন স্নান করতে চলিয়া গেলেন। যাইবার সময় বলিয়া গেলেন–“পার্শ্বের কামরায় এক বাবু বসে আছেন। সেখানে যেয়ে আপনি আপনার এজাহার দিন, তিনিই তদারকে যাবেন।”
খোরশেদ নবাবি কায়দায় আরাম কেদারায় বসিয়া আলবোলা টানিতেছিল। লোকটি ‘বাবু’ বলিয়া প্রায় এক ঘণ্টা দাঁড়াইয়া থাকিল। খোরশেদ কথা কহিল না। অনেকক্ষণ পরে
ওষ্ঠ ভিজাইয়া বিকৃত কণ্ঠে আবার সে কহিল বাবু।
নল হইতে মুখ তুলিয়া খোরশেদ অবজ্ঞার সহিত বলিল–“বারন্দায় বসে থাক, সুযোগ মতো ডাক দিব। হাতে কত কাজ আছে দেখতে পাও না?” আর কথা না বলিয়া লোকটি ভয়ে বারান্দায় জানালার নিচে বেড়া হেলান দিয়া বসিয়া পড়িল।
খোরশেদ কেদারায় বসিয়া তামাক খাইতেছিল। বড় দারোগা আহারের পর পান চিবাইতে চিবাইতে ঘুমাইয়া গিয়াছেন, তখনও উঠেন নাই। থানার সকলেই আহার করিয়া কেহ নিদ্রিত কেহ গল্প ও হাসি-ঠাট্টায় ব্যস্ত। খোরশেদ আগেই খাইয়া আসিয়াছিল।
বেলা তখন শেষ। রমণীমোহন তখনও খায় নাই। ক্ষুধা ও মানসিক বেদনায় নিতান্ত ক্লান্ত হইয়া মাথায় রেশমি চাঁদরখানি পুঁজিয়া দিয়া সে ঝিমাইতেছিল।
সূর্যের ম্লান আলোক-বন্যায় থানা–ঘরের অঙ্গখানি ধৌত হইতেছিল। বেলা শেষের করুণ ছায়া মানুষের মনকে তখন সন্ধ্যাসঙ্গীত শুনাইবার আয়োজন করিতেছিল।
রমণীমোহন হঠাৎ তাহার মাথার একটা শীতল স্পর্শ অনুভব করিল। ছিঃ ছিঃ! কে যেন জানালা দিয়া তাহার মাথায় থুতু ফেলিয়াছে। রাম, রাম, বলিয়া জানালার পার্শ্বে বসিয়া আছে বলিয়া সে নিজের বুদ্ধিকে ধিক্কার দিতে দিতে সরিয়া বসিতেছিল, সহসা। স্কন্ধের উপর খানিকটা আগুন পড়িল। সে বাপরে বলিয়া উচ্চস্বরে চীৎকার করিয়া উঠিল। চীৎকার শুনিয়া বড় দারোগা সাহেব বাসা হইতে বাহির হইয়া পড়িলেন। সিপাইরা ঘটনাস্থলে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল–“বেটা, কী হয়েছে?
রমণী গ্রামে ভদ্রসন্তান বলিয়াই পরিচিত ছিল। এমন দুর্দশা ও অপমানের মধ্যে সে কখনও পড়ে নাই।
সে বড় দারোগাকে লক্ষ্য করিয়া কহিল–“দারোগা বাবুকে যেন আমার মাথায় থুতু ও হুঁকার জল ফেলিয়া দিয়াছে”।
খোরশেদ আরামে বসিয়া তখনও হুঁকা টানিতেছিল। বড় দারোগার সাড়া পাইয়া সে বাহিরে আসিয়া কহিল–“ওখানে যে একটা মানুষ বসিয়া আছে তা বুঝি নি। অত লক্ষ্য না করিয়া হুঁকার একটু জল ফেলিতে গিয়া টিকা ফেলিয়া দিয়াছিলাম। কাজটা বড় খারাপই হয়েছে।”
আজিজ মিয়া বিরক্ত হইয়া কহিলেন ”আপনি তো সাহেব, বেশ ভদ্রলোক। অফিসিয়াল ওয়ার্ক আপনি এইভাবে করছেন? এজাহার নেওয়া হয়েছে”?
খোরশেদ নিঃসঙ্কোচে রমণীর দিকে একটা রুক্ষ কটাক্ষ নিক্ষেপ করিয়া কহিল–“হয়েছে”।
.
অষ্টবিংশ পরিচ্ছেদ
তদারক হইতে রমণীর ঘরণীকে তস্কর সাব্যস্ত করিয়া খোরশেদ অনেক রাত্রে নিস্তব্ধ বাসার প্রবেশপথে দাঁড়াইয়া ঝিকে ডাক দিল। ঝি ত্রস্তভাবে দরজার কাছে আসিয়া মৃদুভীত স্বরে কহিল–“বাবা! একটা মেয়ে আপনার সন্ধানে এসেছেন। তিনি বিশেষ কোনো কথা বল্লেন না। সঙ্গে কেউ ছিল না।”
খোরশেদ অবাক হইয়া জিজ্ঞাসা করিল–“কোথায় তিনি?–কোন্ সময়ে এসেছেন? আর কেউ কি জানতে পেরেছেন?
“না–সন্ধ্যার অন্ধকারে তিনি এসেছেন। বেহারারা দরজায় নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। পেছন রাস্তা দিয়ে তারা এসছিল। ও বাসার ঝি আর খুকিরা এসেছিল, উনি তাদের সঙ্গে কথা বলেন না।”
ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া চেয়ারে উপবিষ্ট গিরির পাণ্ডু মুখচ্ছবির দিকে খোরশেদ নির্বাক স্থিরনেত্রে অনেকক্ষণ চাহিয়া রহিল।
গিরি উঠিল না–দাঁড়াইল না, কোনো কথা কহিল না। সে শুধু করুণ নেত্রে খোরশেদের দিকে তাকাইয়া রহিল।
খোরশেদ কাপড় খুলিল না। স্বেদবিন্দুগুলি শুভ্র ললাটে শুকাইয়া গেল। ঝি দরজার ধারে অগ্রসর হইতেছিল, খোরশেদ তাহাকে চলিয়া যাইতে কহিল। খোরশেদ জিজ্ঞাসা করিল–“গিরি–কেন আসিয়াছ?”
অকম্পিত স্বরে গভীর আবেগে গিরি কহিল–“তোমার কাছে আসিয়াছি।”
“স্ত্রীলোকের পক্ষে এরূপভাবে পথে বাহির হওয়া ঠিক নয়, তা জান?”
“না।”
“আমার কাছে কেন এসেছ?” গিরির কণ্ঠস্বর অকস্মাৎ রুদ্ধ হইয়া আসিল। সবই কী ভুল!
সে কহিল–“চন্দ্রকরোজ্জ্বল রজনীকে বুকে দাঁড়িয়ে তুমি যা বলেছিলে তা আমার মনে ছিল। সেই পুকুর ঘাটের পরিচয়টুকু তোমাকে জীবনের বড় আপন করে তুলেছিল। এসেছি আপন মানুষের কাছে–তোমার প্রশ্ন অতি নিষ্ঠুর। তুমি বিশ্বাসঘাতক নও তো?”
খোরশেদ বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিল–“সে কী কথা? তুমি কী বলছো?”
“গত জীবনের প্রণয় ও ভালবাসার কথা কি ভুলে গেছ! সংসারে আর আমার আপন। বলতে কেউ নাই। আমার দুঃখ ও বেদনার কোনো খবর তুমি নাও নাই। আমি তোমার কাছে এসেছি!”
“কেন?”
গিরির চক্ষু দিয়া ঝর ঝর করিয়া জল পড়িতে লাগিল। সে অতি কণ্ঠে কহিল–“আমি তোমাকে ভালবেসেছি–যেমন তুমি আমাকে ভালবেসেছিলে।”
“আমি কখনও তোমাকে ভালবাসি নি!”
মিথ্যা কথা–তুমি আমার কৃপা ভিক্ষা করিছিলে–তুমি আমাকে ভালবেসে পাগল হয়েছিলে–মন তোমার দিকে গড়িয়ে পড়লেও আমি আমাকে রোধ করেছিলাম। আমি হিন্দু, তুমি মুসলমান!”।
“এখন তো তাই আছি–আমি যার জন্যে পাগল হয়েছিলাম সে কথা জীবনে কাকেও বলবো না। তোমাকে ভালবাসি বলেছিলাম, তার অর্থ-প্রতিশোধ।”