দুঃখ, বেদনা ও জীবনের এই দুরবস্থার মধ্যে গিরি মনে পড়িতে লাগিল খোরশেদের কথা। কত বড় একটা দুর্লঙ্ঘ্য বাধা তাহাদের মধ্যে বিদ্যমান, তাহা সে প্রথমে ভাবে নাই। খোরশেদ যুবক–সে যুবতী। তর্ক, ন্যায় ও বিচার ডিঙ্গাইয়া মন তাহার খোরশেদের কাছে নত হইয়া পড়িয়াছিল।
কিন্তু যখন সে বুঝিতে পারিল, তাই এই প্রণয়ের কোনো মীমাংসা হইবে না, তখন সে খোরশেদকে দূরে দূরে রাখিয়া নিজেকে সামলাইয়া লইল। খোরশেদ ইহাতে কতখানি বেদনা পাইয়াছিল তাহা সে জানে না।
গিরি এখন কেবল ভাবে–এই দুঃখ-বেদনার মাঝে কে বাঁচিতে পারে? খোরশেদের কথা তার মনে পড়ে। মাঝে মাঝে গিরি বলিয়া উঠে
কীসের ধর্ম?–এত অত্যাচার ও অবিচার যে ধর্মে প্রশ্রয় দেয় সে ধর্মকে অবলম্বন করে কে থাকতে পারে?
প্রথম প্রথম সে মুসলমানকে খুব ঘৃণা করিত। খোরশেদকে যে সে মনে স্থান দিয়াছিল মুসলমান রূপে নয়–হিন্দুরূপে। সে যে মুসলমান এ কথা মনে করিতে সে প্রথম প্রথম ভুলিয়া যাইত।
এই দুর্দিনে যখন সে বুঝিল তার বিবাহের কোনো সম্ভাবনাই নাই তখন তার মনে আসিতেছিল খোরশেদের কথা। সে এখন মুসলমানকে শ্রদ্ধার চোখে দেখিতে শিখিয়াছে। প্রেম, মায়া ও মমতাহীন হিন্দুধর্মকে আর সে জড়াইয়া থাকিতে পারিতেছে না। সে তো মানুষ।
খোরশেদ কি সত্যিই তাহাকে ভালবাসে? গিরি নূতন করিয়া ভাবিল–ভালবাসে।
এমনি করিয়া চিন্তায় চিন্তায় দিনগুলি কাটিয়া যাইতেছিল। তার চাচার মেয়েগুলির বিবাহ হইয়া গেল, তাহার হইল না। হইবার সম্ভাবনাও ছিল না। তবে চাচা প্রতিবেশীদের কথার বাণে অনেক সময় বিবাহের জন্য একটু ব্যস্ত হইয়া উঠিতেন। কিন্তু যখন অর্থের কথা ভাবিতে হইত তখন সকল উৎসাহ দমিয়া যাইত। গিরির বিবাহ দিবার তার ইচ্ছা ছিল না তা নয়–অবস্থা এমন হইয়া দাঁড়াইল যে সে ইচ্ছার কোনো মূল্য রহিল না।
চাচি গোপনে স্বামীকে কহিলেন–নিজের ঘাড়ে যখন এতগুলি মেয়ে তখন পরের মেয়ে ঘাড়ে লইবার সময় অগ্র-পশ্চাৎ ভেবে দেখা উচিত ছিল।
সে রাত্রে গিরির ঘুম হইতেছিল না। অনেক রাত্রে চোখ বুজিয়া সে শুনিল-বারান্দার অন্ধকারে চাচা স্ত্রীর সহিত তারই বিষয়ে কী যেন বলিতেছেন। সে উৎকর্ণ হইয়া শুনিল চাচা কহিলেন–“গিরির বিয়ে দেওয়া তো বড় বিপদ হল। তার বাবার কালের যে কয় বিঘা জমি আছে তাই বিক্রি করে ফেলি। তাতে ৭০০ টাকা হবে, বাকি আমরাই দেই।”
চাচি বিরক্তির সহিত কহিল–“গহনার দেড়টি হাজার টাকা কে দেবে?”
“তার মায়ের গহনা তো আছে। আর বেশি কী লাগবে?”
“ও মা!” বলিয়া চাচি বলিল–“সে গহনা না আমার ছোট মেয়ে নিশার গায়ে গিরি পরিয়ে দিয়েছিল? গহনার উপর নিশার মায়া হয়ে যায় নি? কি করে তার গা থেকে সেগুলি খসাবো?”
“নিশা ডবল ডবল গহনা দিয়ে কী করবে?”
“যে জিনিস নিশা অনেক দিন ধরে নিজের জিনিসের মতো করেই পরেছে–তার আর খসান যায় না। জমি বেচে ফেলার কথা বলছো তাই-বা কী করে সম্ভব? ধর গিরির বিয়ে হল–সেই যদি বিধবা হয়ে আমাদের ঘাড়ে ফিরে চাপে তাহলে উপায়?”
গিরি সব শুনিল। সে নড়িল না শুধু নীরবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিল। একাকী ঘরের মাটির উপর একখানা ছিন্ন কাথার উপর সে শুইয়া ছিল। একবার সে জানালা দিয়ে আকাশের পানে তাকাইল। নিশীতে আজ সে তাহার বেদনা স্পষ্টভাবে বুঝিল। কেমন তার এই দুঃখ-বেদনা? মানুষের দুঃখ-বেদনা হয়, সে কয়দিনের জন্য! দুঃখের কি কোনো মীমাংসা নাই? সে আরও দুঃখকে জয় করিয়া সে কি পুরুষের মতো নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করিতে পারে না? নারী বলিয়া একাকী আপনার মতো সে শুকাইয়া মরিবে? পরের জীবন নয়, শুধু নিজের জীবনকে বাঁচাইয়া রাখিবারও কি তার সামর্থ্য নাই?
গিরি ভাবিল–নিরাশা, বেদনা ও অবহেলার মাঝে সে তার এক মুহূর্তও সেখানে তিষ্ঠিতে পারে না।
গিরি যতই চিন্তা করিতে লাগিল খোরশেদ ততই অভিনব বেশে তার মনের ভিতর দেখা দিতে লাগিল। তার মনে হইল, খোরশেদের প্রতি সে অবিচার করিয়াছে। খোরশেদ মুসলমান–তাতে ক্ষতি কী? খোরশেদ তার অতি আপনারা। এ সংসারের দরদ বুঝিবার কেউ যদি থাকে তবে সে খোরশেদ। তার সমাজতার ধর্ম-কাহারো তার বেদনা বুঝিবার ক্ষমতা নাই।
.
সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ
সেদিন খোরশেদ অফিসেই ছিল। বড় দারোগা আবুল হোসেন মিয়া নিজের সেরেস্তায় বসিয়া ডাইরি লিখিতেছিলেন। এমন সময় একজন হিন্দু আসিয়া বড় দারোগার সম্মুখে দাঁড়াইল।
লোকটির দেহ কাঁপিতেছিল।
তাহার মাথায় একটি চুলও ছিল না। আবুল হোসেন মিয়া লোকটিকে উপবেশন করিতে কহিয়া সমাচার জিজ্ঞাসা করিলেন। সে কহিল, “আমার নাম রমণী। বাড়ি সোনাপুর। গতরাত্রে আমার একটা গহনার বাক্স চুরি গিয়াছে। আমার সর্বস্ব তাতে ছিল।” তাহার পর কাঁদিয়া কহিল–“আমার সর্বনাশ হয়েছে। শুনেছি হুজুর সদাশয় ব্যক্তি। দীন দুঃখীর প্রতি আপনার দয়া আছে। এ গরিবকে হুজুর রক্ষা না করলে আর উপায় নাই। গরিবের মা-বাপ আপনি।”
দারোগা সাহেব কহিলেন–আপনি কাকে সন্দেহ করেন?”
“কাকে সন্দেহ করবো? সে কথা বলতে আমার ভয় হয়।”
“কোনো ভয় নাই। অসঙ্কোচে সব কথা বলুন।”
“বাড়ির কাছে এক ঘর দুর্দান্ত মুসলমান আছে। জানেন তো বাবু, মুসলমানেরা ভয়ানক লোক। তাদের উপরেই আমার সন্দেহ হয়। সেই বেটারা ছাড়া আর কেউ এ কাজ করতে সাহস পায় নাই। দোহাই আপনার! তারা যেন কোনো কিছু শুনতে না পায়, তা হলে অর্থের সঙ্গে সঙ্গে আমার প্রাণও যাবে।”