খানিক পথ চলিয়া শুনিলেন কে যেন আর্তস্বরে কাঁদিতেছে!
বাহকেরা বাহির-বাড়িতে টাকার জন্য অপেক্ষা করিতেছিল। রায়হান পকেট হইতে তাড়াতাড়ি দেড়টি টাকা দিয়া তাহাদিগকে বিদায় করিয়া দিলেন। তাহার পর একেবারে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিলেন।
সম্মুখে আমেনা–মূর্তিমতী করুণা–রায়হানকে দেখিয়াই সে মূৰ্ছিতা হইয়া মাটিতে পড়িয়া গেল।
.
পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ
বিপুল লাঞ্ছনা ও অসম্মানের স্বামী কর্তৃক বর্জিতা জন্মের মতো আমেনাকে ফিরিয়া আসিতে হইয়াছে। তার হীন ও অর্থলোভী শ্বশুর পুত্রবধূকে একাকী বিধবার বেশে পথে তুলিয়া দিয়াছিল। খোরশেদের দুর্ব্যবহারের প্রতিশোধ বধূকে লাঞ্ছিতা করিলেই সিদ্ধ হইবে এইরূপ নজির মিঞা ভাবিয়াছিল।
এনায়েত বধূর অপমানে সন্তুষ্টই হইয়াছিল। পিতা পুত্রকে অনেক টাকা ব্যয় করিয়া নূতন এক রূপবতী কন্যার সহিত বিবাহ দিবেন, ইহাও সে শুনিয়াছিল।
আমেনা ইদানিং কথা বলি না। হৃদয়ের সীমাহীন দুঃখ সে সযতে বুকের ভিতর লুকাইয়া রাখিত। যেদিন তাহাকে চরিত্রহীনা বলা হয় সেদিন হইতে সে মৌন হইয়া গিয়াছিল।
বিবাহ জিনিসটাকে স্ত্রীলোকের স্বভাব অনুযায়ী সে বাল্যকলে অনেকখানি রং লাগাইয়া ভাবিত। যখন সংসারে প্রবেশ করিয়া অপরের বধু হইয়া আনন্দ খুঁজিতে সে একটা ব্যাকুল হইয়াছিল, তখন ভাগ্য তাহাকে দিয়াছিল অমৃতের পরিবর্তে বিষ-সুখের পরিবর্তে জ্বালাময় কন্টক এবং সীমাহীন সঙ্কীর্ণতা।
বাড়ি আসিয়া কয়েকদিন অতিবাহিত হইয়া গিয়াছে। খোরশেদ বাড়িতে টাকা পাঠায়, বাড়িতেও আসে না। সে তার ভগ্নির অপমানের কথা শুনিয়া মায়ের কাছে উত্তর লিখিয়াছে–স্বভাবদোষে আমেনা বর্ধমানে টিকিতে পারে নাই।
অতি আপনার জনের মতো সেদিন রায়হান আসিয়া আমেনাকে বলিয়া গিয়াছে–খোদার বিধানকে মাথায় পাতিয়া লইতে হইবে, উহাতেই জীবন ও আত্মার মঙ্গল। উহাকে দুঃখ প্রকাশ করা ভুল।
আমেনা তাহার গুরুর কথায় শান্তিলাভ করিয়াছে। কিন্তু একদিন অতীত জীবনের করুণ চিন্তা আসিয়া তাহাকে ব্যথিত করিয়া তুলিয়াছিল। তাহার আঁখিপল্লব সিক্ত হইয়া উঠিয়াছিল। যদি তাহার বর্ধমানে বিবাহ না হইত, তাহার জীবনধারা যদি অন্যভাবে বহিত!
রায়হান তার গুরু। কয়েক বছর আগে সে যখন রায়হানের প্রতিভা-মণ্ডিত উজ্জ্বল চক্ষুর সম্মুখে বসিয়া বক্তৃতা শুনিত, তখন তার বালিকা-চিত্ত একটা কথা ভাবিত–যা সে কাহারও কাছে বলিতে সাহস পাইত না।
মায়ের অসীম স্নেহ-রায়হানের গভীর অকৃত্রিম সহানুভূতি তাহাকে আবার হাস্যময়ী করিয়া তুলিয়াছে। সে তার গত অপমানের কথা ভুলিতে পারিয়াছে।
রায়হান যখন তার মাকে সালাম করিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করে–কেমন আছ? আমেনার তখন ইচ্ছা করে রায়হান ভায়ের পায়ের কাছে নত হইয়া বলে আপনার আশীর্বাদে ভালো আছি। তার গুরু রায়হান ছাড়া অমন করিয়া এতকাল পর্যন্ত কেউ জিজ্ঞাসা করে নাই, সে কেমন আছে। এমন সরলতা, এমন সহানুভূতি সে কোথায়ও দেখে নাই। তার গুরুর উপর তার ভক্তি বেশি করিয়া বাড়িয়া উঠে।
একদিন বৈকাল বেলা নাফিসা রায়হানকে ডাকিয়া কহিলেন, বাবা, তোমার। বোনকে একটু কোরান পড়াতে পার? শুধু মতন পড়তে পারলেই হবে না। ব্যাখ্যা ও ভাবসহ কোরানের বাণীগুলি আলোচনা করবে। তার মনের উন্নতি হোক, খোদার উপর সে বেশি করে নির্ভর করতে শিখুক।
রায়হান কহিলেন–আপনার প্রস্তাবে আমি খুশি হলাম। তার মনের উন্নতি যথেষ্ট হয়েছে, আরও হবে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে একটা সেলাইয়ের কল কিনে দিতে চাই। ভদ্রঘরের মেয়েদের জন্য অনেক বিষয় চিন্তা করতে হবে। আর কিছু না হোক উপার্জিত অর্থ দিয়ে দীন-দুঃখীর দুঃখ দূর করা তো যাবে।
“একটা যন্ত্রের দাম দেড়শ টাকার কম নয়। খোরশেদ এক পয়সা দেয় না। ষাট টাকার ধান বিক্রি হয়েছিল, তাই দিয়ে বাজার চলছে।”
‘টাকার কথা আপনাকে ভাবতে হবে না। শুধু অনুমতি চাই।”
২৬-৩০. সেই রাত্রে মুর্ছা হইতে উঠিয়া
ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ
সেই রাত্রে মুর্ছা হইতে উঠিয়া গিরির মনের ভাব সহসা পরিবর্তন হইয়া গেল। চমকিতা গিরি ভাবিল, কাজ ভালো হইতেছে না। ইহার পর হইতে সে খোরশেদের নিকট হইতে নিজেকে একেবারে দূর করিয়া লইল।
কিন্তু ঈশ্বরের ইচ্ছা! কিছুদিনের মধ্যে গিরির জন্য এমন কিছু ঘটিল, যাহাতে তাহার। জীবন খুবই বিচিত্র হইয়া পড়িল এবং তাহার জ্ঞান ও চিন্তা নূতন গতি প্রাপ্ত হইল।
সুখ, উল্লাস ও গর্বের ভিতর সহসা একদিন কলেরার দৌরাত্মে বাপ-মাকে শ্মশানে রাখিয়া আসিয়া গিরি এক পাশে দাঁড়াইয়া কেবল কাঁদিতেছিল আর নিজের অদৃষ্টের কথা ভাবিতেছিল।
বেদনায় তাহার কয়েক দিন কাটিয়া গেল। অতঃপর নিকটেই দূর সম্পর্কীয় এক কাকার বাড়িতে চলিয়া গেল।
দুঃখের বিষয়, কাহারো অনুগ্রহে কোনো কালে বাচিতে হয় নাই। বাল্যকাল হইতে সে বাপ-মায়ের আদর-সোহাগ পাইয়া আসিয়াছে। পরের বাড়িতে পরের মন যোগাইয়া চলা যে কী বিড়ম্বনা তা সে এতদিনে বুঝিতেছিল।
বাপ-মায়ের মৃত্যুকালেই গিরি খুব সেয়ানা হইয়া পড়িয়াছিল এবং যত দিন যাইতেছিল ততই যেন তাহার বিবাহ বয়স উতরিয়া যাইতেছিল। বিবাহ যে হইবে এইরূপ কোনো আশা সে দেখিতেছিল না।
এমন জীবন যে সম্ভব তা গিরি কোনোদিন ভাবে নাই। তাহার জীবনটা বাহির হইতে কোনো স্নেহ-মমতার অভাবে একেবারে নুইয়া পড়িতেছিল। তার সেই কাকার বাড়িতে সে একটা পরের মেয়ে ছাড়া কিছু নয়।