আমি কি তা জানি না–ভালো কি মন্দ তাহাও বুঝি না। পড়াশুনা আমার সব মাটি হইয়া যাইতেছে। চতুর্থ বৎসরের বড় বড় বইগুলি লইয়া কলেজে আসা-যাওয়া করি মাত্র। অধ্যাপক যখন বক্তৃতা দেন, তখন তার মুখের পানে শুধু চাহিয়া থাকি।
স্কুলের জীবনে কখনও ভাবি নাই, এমন কিছু সম্ভব। যখন স্কুলের জীবন শেষ হইয়া আসিল তখন জীবনের সম্মুখে এক নূতন পথ খুলিয়া গেল। প্রথমে উপেক্ষা করিয়াছিলাম, এখন দেখিতেছি এই পথ অতি ভয়ানক। সেই পথের শেষ প্রান্তে দেখিয়াছিলাম এক বালিকা মূর্তি–সে আমেনা।
সেই মিলাদ শরিফের দিন জোছনার আলোক অভিনব বেশে দেখিয়াছিলাম সেই বালিকাকে। আমরা শিরায় শিরায় যেন একটা তড়িৎ প্রবাহ ছুটিয়াছিল। আমার শক্তি ও মনের অবহেলা উপেক্ষা করিয়া সে শত ভাবে আমার সম্মুখে দাঁড়াইয়াছিল। তবুও তাহার সম্মুখে তখন আমি শক্তিহীন হইয়া পড়ি নাই মনে করিয়াছিলাম তাহাকে বিবাহ করিব, কিন্তু যে কারণেই হউক তাহা হয় নাই। আমি নিজের কাছে নিজে লজ্জিত ছিলাম। মা ছাড়া কাহারও কাছে জীবনের এই কথা ভালো করিয়া ব্যক্ত করিতে সাহস পাই নাই!
ধীরে ধীরে বালিকা-রানী এই দীর্ঘ চারি বৎসরের চেষ্টায় আমাকে একেবারে মুহ্যমান করিয়া তুলিয়াছে। দেহমন সব শক্তিহীন হইয়া পড়িয়াছে। কোনো আশা নাই–তবুও অহর্নিশি আত্মা আমার অবুঝ শিশুর মতো সেই ছোট বালিকাটির কথাই ভাবে।
মনে মনে তর্ক করিয়াছি–এ সবই ভুল–দেহকে ধ্বংস করা ছাড়া আর কিছু নয়। অনেকবার মনকে বিদ্রোহ করিয়া তুলিতে চেষ্টা করিয়াছি। কিন্তু সকল মীমাংসা মুহূর্তের মধ্যে চূর্ণ হইয়া গিয়াছে।
একটা মানুষ আমাকে এমন করিয়া শক্তিহীন করিতে পারে, একথা ভাবিতেও আমি মাঝে মাঝে লজ্জিত হই। কারণ খুঁজিয়া পাই না–তবুও ভাবি এটা কী? খোদা জানেন।
নির্জনে যখন থাকি তখন ভাবি–তারই কথা। বাতাসের মাঝে তারই অস্তিত্ব অনুভব করি। জোছনামাখা আকাশের পানে তাকাইয়া ভাবি মিথ্যা আমার জীবন সংসারের আলো-বাতাস আমার কাছে নিরর্থক। বিশ্বের সম্পদ একটা বিরাট আবর্জনাস্তূপ। আমি নিঃসহায়!–শুষ্ক বেদনা লইয়া এই দীর্ঘ জীবনটাকে টানিতে হইবে! সে কতদিন–কত বছর। দুঃখভরা দারুণ ব্যর্থতা।
যদি মানব সমাজ ছাড়িয়া তাহাকে লইয়া সমুদ্রগর্ভে থাকিতে হইত তাহাতেও আমি খুশি হইতাম।
এই জ্বালা কীসে নিবৃত্ত হইবে জানিতে চাই। সংসারের সকল আসক্তি নিবিয়া গিয়াছে। কী বিস্ময়–সেই বালিকাকে তো আর পাইবার আশা নাই, তবুও এ দুঃখ কেন! যে দুঃখের শেষফল শুধু হাহাকার ও বেদনা, সে দুঃখের এত অত্যাচার কেন?
তার রূপ শত গরিমায় মনের পটে ভাসিয়া উঠে। চোখের সম্মুখে সে সদা খেলিয়া বেড়ায়। তার হাসি কী ভয়ানক ও জ্বালাময়!
কয়েকদিন আগে ইচ্ছা হইয়াছিল বর্ধমানে যাইয়া তাহাকে দেখিয়া আসি। কিন্তু কী উপলক্ষ্য করিয়া তাহার সহিত দেখা করিব? আমি তো আর কেউ নই। তার স্বামীর সঙ্গেও আমার দেখাশুনা নাই।
একটা বড় আশ্চর্য কথা–বিবাহের পর আমেনা তো একবারও বাড়িতে আসিল না।
আমেনা–মহারানী আমেনা-দেবী, গরিমাময়ী–যাহার চরণস্পর্শ করিয়া মাটি ধন্য হয়–যাহাকে বিবাহ করিয়া সারা জীবন ভিখারির বেশে দ্বারে দ্বারে ঘুরিলেও ক্ষতি হয় না,–সে কোথায়?
প্রিয়তম ভাই–শক্তি ও সান্ত্বনা চাই–আমাকে পথ দেখাও–তোমার পত্রের জন্য উদগ্রীব হইয়া রইলাম।
.
চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ
রায়হান চিঠি পড়িয়া একেবারে স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। তাহার ললাট স্বেদসিক্ত হইয়া উঠিল। ধমনীতে উষ্ণ রক্তস্রোত আরও উষ্ণ হইয়া উঠিল।
পত্রখানি বাম হস্তে তুলিয়া লইয়া রায়হান দক্ষিণ হস্ত দিয়া তাহা দুই ভাগ করিয়া ফেলিলেন। তাহার পর ডেস্ক হইতে চিঠির কাগজ বাহির করিয়া লিখিলেন।
১৭/৭
ওমেদপুর
প্রিয় হামিদ! তোমার পত্র পাইয়াছি। জীবনে যে এমন পত্র পড়িতে হইবে ইহা কখনও ভাবি নাই। পরস্ত্রীর রূপ লইয়া ঢলাঢলি করিতে কে তোমাকে শিক্ষা দিয়েছে? তস্করের ন্যায় পর রমণীর কথা ভাবিতে একটুও লজ্জা বোধ হয় না? বস্তুত তোমার পত্রে আমি যারপরনাই দুঃখ পাইয়াছি। ক্রোধ ও ঘৃণা যুগপৎ আমাকে বেড়িয়া ধরিয়াছে। হীন প্রকৃতির লোক ছাড়া এমন গোপন ব্যভিচার করিতে কেউ সাহস পায় না। তুমি আমাকে অত্যন্ত বেদনা দিয়াছ। বিধাতার বিধানের বিরুদ্ধে দাঁড়ান কী প্রকার মনুষ্যত্ব বুঝিতে ইচ্ছা করে না।
০ ০ ০ ০
ডাকঘরে পত্র দিয়া রায়হান যখন ফিরিয়া আসিলেন তখন দুপুর। তখনও তাহার খাওয়া হয় নাই। চিত্তা তাহার বড় বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছিল, বুকের ভিতর রক্তপ্রবাহ বিক্ষুব্ধ। তরঙ্গের মতো আছাড় খাইয়া পড়িয়াছিল। তীব্র উজ্জ্বল সূর্যকিরণমাথা আকাশের পানে রায়হান চাহিয়া দেখিলেন–আঃ!
পথ ধরিয়া একখানা পাল্কি আসিতেছিল। রায়হান বিস্ময়ে দেখিলেন সঙ্গে কেউ নাই। বাহকদিগকে রায়হান জিজ্ঞাসা করিলেন–“পাল্কি আসছে কোথা হতে?”
”জে আজ্ঞে–এই স্টেশন থেকে।”
“সঙ্গে কেউ নাই?”
“জে না!”
“কোথায় যাচ্ছ?”
“খোরশেদ মিঞার বাড়ি–তার ভগ্নি বর্ধমান থেকে এলেন। আমরা তো আর পর নই–দোষ কী, কেউ না থাকলে”?
রায়হান বজ্রাহতের ন্যায় সেখানেই দাঁড়াইয়া রহিলেন! পাল্কি চলিয়া গেল।
দোকানে না যাইয়া রাস্তা হতেই বুকের ভিতর একটা দারুণ আশঙ্কা লইয়া রায়হান খোরশেদের বাড়ির দিকে ছুটিলেন।