রায়হান আপত্তি করিলেন না।
করিমা ছোট একখানা কাঁসার থালায় কতকগুলি মুড়ি, কয়েকটা নারিকেলের নাড় –একটু হালুয়া এবং খানিকটা সর আনিয়া দিল।
মনের একটা দারুণ বেদনা, একটা ছোট চাপা দীর্ঘশ্বাসের আকারে করিমার বুকখানাকে সহসা কাঁপাইয়া গেল। তাহার উজ্জ্বল নীল চক্ষু একটু শিহরিয়া উঠিল। বাহিরে স্নিগ্ধ নীল ও উজ্জ্বল প্রকৃতির পার্শ্বে করিমার পেলব-গৌর দেহখানি স্বপ্নমাধুরী সৃষ্টি করিতেছিল। সে যখন দাঁড়াইল তখন বোধ হইতেছিল একখানা তরল, অতি সুন্দর কনক প্রতিমা জোছনার উপর দাঁড়াইয়া পৃথিবীর ললাটে একটা মাধুরীর টিপ কাটিয়া দিতেছে।
হাত ধুইয়া রায়হান বলিলেন–“চাচি! আবার এখনি আমাকে খেয়ে দোকানে যেতে হবে।”
হাফিজা বলিলেন–“আচ্ছা বাবা! তাহলে যাও।”
.
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
বৈকালবেলা মৃদু মন্দ বাতাস বহিতেছিল। শেফালিকা গাছের তলায় দাঁড়াইয়া নীল অঞ্চলখানা উড়াইয়া দিয়া আমেনা একখানা শিলার উপর পা রাখিয়া তাহাতে মেহেদীর পাতার রঙ লাগাইতেছিল।
নীল বসনের নিচে রক্তরাঙ্গা কচি কুসুমগুচ্ছের মতো পা দুখানি স্বল্পসুষমা সৃষ্টি করিয়াছিল। সে বুঝিতেছিল না বৈকালবেলায় স্নান প্রকৃতির গায়ে কতখানি গৌরব সে ভরিয়া দিতেছে। কাল কেশগুচ্ছের পাশে তার কিরণময় মুখখানি যেন শ্যামল পল্লব-লতার ভিতরকার একটা লাল গোলাপ বলে ভ্রম হইতেছিল।
রায়হান দূর হইতে দেখিলেন শত সৌন্দর্যে ছোট বালিকা দেহটিকে ভরিয়া সুষমাময়ী আমেনা দাঁড়াইয়া আছে।
নজর পড়িতেই আমেনা একেবারে বিদ্যুৎবেগে বাড়ির ভিতর যাইয়া রান্নাঘরে প্রবেশ করিল।
নফিসা মেয়ের আকস্মিক চাঞ্চল্যে বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন–“কিরে, কী হয়েছে?”
দরজার ওপাশে দাঁড়াইয়া আমেনা চাপা গলায় ফিক ফিক করিয়া হাসিতেছিল।
রায়হান নফিসাকে আদাব করিয়া মাটির উপর বসিয়া পড়িলেন।
নফিসা বিস্ময়ে কহিলেন–“রায়হানকে দেখে এত লজ্জা! শীগগির একখানা পাটি নিয়ে এসে তোমার ভাইকে বসতে দাও।”
রায়হান বলিলেন–“আমেনা হয়তো মনে করেছে আর কেউ।”
কেন অমন করিয়া ছুটিয়া পালাইয়া দরজার ধারে আসিয়া সে দাঁড়াইয়াছে তা আমেনা নিজেই ঠিক করিতে পারিতেছিল না। একটা সহজ ভাব মুখের উপর ফেলিয়া আমেনা রায়হানের সম্মুখে একখানা মাদুর পাতিয়া দিল।
নফিসা মেয়েকে বলিলেন–“তোমার ভাইয়ের পা চুম্বন করো।” একটু থামিয়া অন্যদিকে মুখ করিয়া পুনরায় কহিলেন–“রায়হানের কাছে আমেনা চিরজীবন ঋণী, সেই বিপদের কথা কখনো ভুলবো না। আর একটু হলেই মেয়ে আমার মরে যেতো।”
রায়হান মৃদু হাসিয়া বলিলেন–“থাক্। সালাম-শ্রদ্ধা না হলেও আমি ওকে ভালবাসি।” একটুখানি যে কোনো রকম আঘাত যেমন বেহালার তারে অনেকক্ষণ পর্যন্ত সুরময় হইয়া বহিতে থাকে, রায়হানের মুখের কথাগুলি তেমনি করিয়া আমেনার মনের মধ্যে অনেকক্ষণ ধরিয়া বাজিতে লাগিল। সে ভাবিল, মা ছাড়া আরও একটা মানুষ তাকে ভালবাসে, এ তো, সে জানে না। ভাই তাকে ভালবাসে না, যদিও সে নিজে ভাইকে খুব ভালবাসে।
মুখখানি একটু টানিয়া লইয়া মোহন হাসির আলোয় কপোল ও ওষ্ঠদ্বয় প্রভাময় করিয়া আমেনা কহিল–“আমিও আপনাকে খুব ভালবাসি।”
মা বালিকার সরলতা ভরা কথায় একটু হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন–“তুই তোর রায়হান ভাইকে কেমন করে ভালবাসিস?”
আমেনা কহিল–“কেন মা, আপনাকে যেমন করে ভালবাসি?”
রায়হান হাসিয়া বলিলেন–আমি কি তোমার মা?
আমেনা কহিল-মাইয়ের মতো। ভাইয়ের মতো নয়।
নফিসা ও রায়হান আমেনার কথায় অনেকক্ষণ ধরিয়া হাসিলেন।
ছোট অবগুণ্ঠনের ভিতর ছোট মুখখানি অভিনব বলিয়া বোধ হইতেছিল। মৃদু হাসির ক্ষীণ তরঙ্গ মাঝে মাঝে আমেনাকে আরও নয়ন মোহন করিয়া তুলিতেছিল।
রায়হান বলিলেন–আমেনা, পড়ে থাক?
আমেনা ঘাড় নাড়িয়া বলিল–না।
নফিসা কহিলেন–ও পড়ে না।
রায়হান–কিছুই পড়ে না?
নফিসা–শুধু কোরান পড়েছে। এখন আর কিছু পড়ে না।
রায়হান–তাতে মনে একটু পবিত্রতার ভাব জেগে উঠতে পারে। কিন্তু তাতে মনের অন্ধকার দূর হতে পারে না। মনের অন্ধকার দূর না হলে কোরান পড়া বৃথা।
নফিসা–তুমি ঠিক কথা বলেছ বাবা। জ্ঞানের দ্বারা মনকে চাষ না করতে পারলে ধর্ম পালন হয় না। লোকের সঙ্গে উঠতে বসতে পারা যায় না। শিক্ষিত লোকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বোকা হতে হয়।
রায়হান–তা হলে আমেনাকে একটু একটু পড়াবার ব্যবস্থা করুন না কেন?
নফিসা–তা করা দরকার। কেমন লেকের হাতে পড়ে তার ঠিক নাই। খোদার মরজি হলে আর বেশি দেরিও নাই। লেখাপড়া না শিখলে হয়তো তাকে পদে পদে লাঞ্ছিত হতে হবে। তুমি ভালো কথা মনে করে দিয়েছ। বাবা! আমেনার আত্মার উন্নতির জন্য কোনো চেষ্টাই হচ্ছে না। ভালো বর খোঁজবার আগে মেয়েকেও ভালো করে তোলা চাই, এ আমি জানি।
কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ থাকিয়া নফিসা আগ্রহের সহিত আবার কহিলেন–“রায়হান, তাহলে তুমিই একটু একটু করে পড়িয়ে যেও।”
রায়হান–আপনার অনুরোধ আমার কাছে আজ্ঞা বলেই মনে হবে। মেয়ের লেখাপড়ার আবশ্যকতা আপনি বুঝেছেন, এটা বড় আশ্চর্য। আমাদের দেশের অধিকাংশ নারী এত কুসংস্কারাচ্ছন্ন যে, তারা মেয়েদের লেখাপড়া শিখাতে মোটেই চান না।
নফিসা–কী বল, ধর্মে নারী-পুরুষ সকলেরই জ্ঞান আহরণ করবার নির্দেশ আছে। যারা মুসলামান ধর্মের কিছু জানে না–তারা নারী কেন, পুরুষকেও জ্ঞান ও আলোক হতে দূরে রাখে। না বুঝে লক্ষ লক্ষ পবিত্র গ্রন্থ পাঠ করলেও কোনো লাভ হয় না। পাপে ভরা