সুকুমারদের নিকট হইতে রায়হান বাড়িতে আসিয়া সকলের শেষে ভাত খাইতেছিলেন। তাঁর চাচি পার্শ্বে বসিয়া খাওয়াইতেছিলেন। চাচি খাবার মাঝে কহিলেন–“বাবা রায়হান, তোর মা ছোটকালেই মরে গেছেন। মা হলেও আমি, চাচি হলেও আমি। একটা কথা–“।
রায়হান কহিলেন–“কী কথা মা?”
“তোমার ফুপুর মেয়ে সেয়ানা হয়েছে। তার তো বিয়ে না দিলে চলছে না।”
“তা তো ঠিক! সেয়ানা মেয়েকে বিয়ে না দেওয়া ভালো নয়।”
“তোমার ফুপো–মেয়ে ছোট থাকতেই মারা গেছেন। কিছু সম্পত্তি ছিল তাই রক্ষা। ওকে কোথায় বিয়ে দেই? তাদের মুরব্বি তো আমি এবং তোমার বাবা। তোমার বাবা সেখানে গতকাল বেড়াতে গিয়েছিলেন। তোমার ফুপু অনেক কাকুতি-মিনতি করে একটা কথা বলে দিয়েছেন। তার ইচ্ছে হাসিনাকে তোমার সঙ্গে বিয়ে দেন।”
কিছুমাত্র চিন্তা না করিয়া রায়হান কহিলেন–“সে ভালো কথা। তারা যদি এতে ভাবনার মধ্যে পড়ে থাকেন তা হলে আগে বল্লেই তো হতো। অনেক আগেই আমি বিয়ে কত্তাম।”
“বাবা মেয়ে সেয়ানা–অর্থ নাই–গুণ নাই–বিদ্যা নাই, একটা কথাও জিজ্ঞাসা না করে তুমি রাজি হয়ে গেলে। এটা কি তোমার ঠিক কথা, না উপহাস?”
“একটুও উপহাস নয়–মুসলমান ছাড়া অন্য জাতি নয় তো। অশিক্ষিতা মেয়েমানুষের সঙ্গে বাস করা কঠিন হলেও আমার পক্ষে কোনো অসুবিধা হবে না। বয়সকালে মেয়েদের মন কোমল থাকে, সহ্য করে উন্নতি করতে চেষ্টা করলে অতি সহজেই তারা উন্নত হয়। ধৈর্য না থাকলে এবং অসদ্ব্যবহারে, ভালো স্ত্রীলোকও খারাপ হয়ে যায়। নিজের স্ত্রী যে হবে তাকে শিক্ষিতা ও বড় করতে বেশি দিন লাগে না।”
“বড় ঘর নয় বলে তোমার বাবা রাজি হতে নাও পারেন।”
“ঐটা ভয়ানক অন্যায় কথা–মানুষ বড় হবে জ্ঞানে। বিয়ে করে বড় হতে চেষ্টা খেলো মানুষের কাজ। কোনো বড়লোকের সঙ্গে আত্মীয়তা করে নিজের হীনতাকে স্পষ্ট করে তোলা কি ভালো?”
রায়হানের চাচি সন্তুষ্ট হইলেন।
অনেকক্ষণ পরে চাচি বলিলেন–“আজ কদিন মসুর মা আসে না। শুনলাম তার ব্যামো হয়েছে। বেচারা কী খায়! করিমের মা নাকি তাকে খুব জিল্লতি করে।”
রায়হান কথা কহিল না। রাত্রি হইয়া গিয়াছিল বলিয়া সে খাইয়াই তাড়াতাড়ি দোকানঘরে চলিয়া গেল।
দোকানে যাইয়া প্রদীপটা জ্বালিয়া রায়হান একখানি মাসিক লইয়া বসিলেন। থাকিয়া থাকিয়া মনটা যেন বই ছাড়িয়া বাজে চিন্তায় ভরিয়া উঠিতেছিল। বাতি নিভাইয়া রায়হান শুইয়া পড়িলেন। সহজে নিদ্রা না আসাতে জানালা খুলিয়া অন্তহীন মাঠের দিকে তিনি চাহিয়া রহিলেন। কী গম্ভীর নৈশ আকাশ-প্রকৃতির ছায়াময় মূর্তি। রায়হান ভাবিতেছিলেন–আহা, মানুষের কী দুঃখ!
প্রায় দেড় ঘণ্টা হইয়া গেল তবুও রায়হানের ঘুম হইল না। ক্রমাগত এপাশ ওপাশ করিতেছিলেন। তাহার পর সহসা বিছানা হইতে উঠিয়া পড়িলেন। খাটের নিচে একটা। টুকরি ছিল। কতকগুলি চাল, আধসের ডাল, কিছু লবণ, খানিকটা হলুদ, ছোট একটা। শিশিতে খানিক তেল লইয়া হারিকেন হাতে করিয়া রায়হান বাহির হইয়া পড়িলেন।
রায়হান কয়েক মিনিটের ভিতর একটা ছোট কুটিরের সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। মৃত্যুর কাল রেখা কুটিরখানির চারিদিকে ঘিরিয়া ছিল।
রায়হার বাহির হইতে ধীরে ধীরে ডাকিলেন–“মসুর মা?”
ভিতর হইতে একটা অনশনক্লিষ্ট দুর্বল স্বর উত্তর দিল।
রায়হান কহিলেন ”দরজা খোল।”
কষ্টে দরজা খুলিয়া মসুর মা বাতির আলোকে অস্পষ্টভাবে দেখিল–রায়হান।
সে জিজ্ঞাসা করিল–“বাবা রায়হান, এত রাত্রে কী মনে করে? আমার তো ঘুম নাই। বাপ। অনেক দিন হল, মিঞাদের ইন্দারায় পানি আনতে গিয়েছিলাম। পাখানা ভেঙ্গে গিয়েছিল। বড় লেগেছিল”।
তাহার পর ব্যস্ত হইয়া আস্তে আস্তে ময়লা কথাখানা পাতিয়া দিয়ে কহিল–“বসো, বাবা, বসো।”
চালের টুকরি মাটির উপর রাখিয়া রায়হান কহিল–“মসুর মা! কিছু চাল এনেছি, এগুলি তুমি নেও”।
“কেন বাবা–কেন বাবা–চালের দরকার কী?” বলিয়া বুড়ি রায়হানের হাতখানি বুকের কাছে টানিয়া লইয়া কাঁদিয়া ফেলিল।
.
এয়োবিংশ পরিচ্ছেদ
প্রাতঃকালে পিয়ন কাগজ ও অন্যান্য চিঠির সহিত একখানা রেজেষ্ট্রি দিয়া গেল। আগ্রহের সহিত সেখানা খুলিয়া রায়হান পড়িয়া দেখিলেন তাহাতে লেখা আছে–
১৫/৭ সার্কুলার রোড, কলিকাতা।
প্রিয়তম ভ্রাত,
জীবনের গভীর দুঃখের কথা তোমাকে বলতে আমার এতদিন সাহস হয় নাই। চিরকালই ভিতরে ভিতরে একটা বিশ্বাস পোষণ করিয়া আসিয়াছি, তুমি বড় নীরস–আত্মা তোমার স্থবির–শুষ্ক, কঠিন এবং মরুময়। তবুও তোমায় আমি শ্রদ্ধার চোখে দেখি।
বিশ্বাস ও আশা ছাড়া মানুষ বাঁচে না। জীবনে এমন কোন ঘটনা ঘটিতে পারে, যাহাতে মানুষের মন ছিন্নভিন্ন হইয়া যায়। বাহিরে লোকের কাছে তাহা উপহাসের জিনিস। তুমি উপহাস ও তাচ্ছিল্যের ভাবে গ্রহণ করিবে না–এই বিশ্বাসে আমি বলিতেছি, আমার জীবনে এরূপ কোনো ঘটনা ঘটিয়াছে।
সত্যই কি তুমি নীরস? আত্মা তোমার মরুময়? লক্ষ মানুষের প্রচলিত জীবন ধারা, লক্ষ আত্মার পুণ্য মধুকল্পনা ও স্বপ্নকে কি তুমি ঘৃণার চোখে দেখ? তাহা হইলেও আমি আজ তাহা ভুলিয়া যাইব। আজ মানিয়া লইব আমার মতো অনন্ত দুর্বল মানুষের বন্ধু তুমি, ভাই তুমি।
কণ্ঠ আমার শব্দহীন হইয়া উঠিতেছে–লেখনী যেন অবশ হইয়া আসিতেছে, তবুও বলিয়া পারিতেছি না।