মসুর মা এককালে যুবতী বধু ছিল। তার স্বামীর নাম ছিল তমিজ। ত্রিশ বৎসর বয়সের সময় দুইটি পুত্র ও একটি কন্যা রাখিয়া সে মারা যায়। স্বামীর মৃত্যুর পর মসুর মা তার দুই বিধবা বোনকে নিজের বাড়িতে লইয়া আসিয়াছিল। তিন বোনের মধ্যে মসুর মা ই বড়। কুড়োনের মাও ছুটু ছিল মেজো এবং সেজো। বাড়িতে পুরুষ মানুষ না থাকায় সাহায্য ও সাংসারিক ভরসার আশায় বড় বোনের অনুরোধে ছটুকে এক নয়–দুই নয়–পাঁচ পাঁচটা বিবাহ করিতে হইয়াছিল; কিন্তু একটা স্বামীও টিকিল না।
।কুড়োনের মাও স্বামী গ্রহণ করিয়াছিল কিন্তু সকলগুলিই বিবাহের যথাক্রমে ১ মাস, ৩ মাস এবং এক বৎসর পরে কোথায় গিয়াছিল, তা কেউ বলিতে পারিত না।
মসুর মা পুনরায় আর বিবাহ করে নাই। দুটি ছেলের মুখেই সে তার স্বামীর ছবি দেখিত।
খাবারের অভাব তো তাদের ছিল না। যা দুই বিঘা জমি ছিল তাতেই তাদের চলিত। বাড়িতে দুইটি গাভী ছিল। আমগাছের আম আর বাড়ির গরুর দুধ তাহারা তৃপ্তির সহিত পেট ভরিয়া খাইত।
তাহার পর একদিন দুই দিন করিয়া অনেক বছর কাটিয়া গিয়াছিল। হঠাৎ একদিন কলেরায় দুটি বোন এবং সেয়ানা মেয়েটি মরিয়া গেল। রহিল মসুর মা আর তার দুইটি জোয়ান ছেলে।
শেষ বয়সে একদিন মসুর মা বুছিল সংসারে সে একা। নিঃসহায় দুঃখময় তার জীবন। বুক তার ভাঙ্গিয়া গেল। মসু চরিত্রহীন হইয়া, মায়ের কথা একটুও না ভাবিয়া কোথায় চলিয়া গেল। এক এক বছর পরে ছোট ছেলেটিও দুই দিনের জ্বরে তার বোনদের মত অন্তঃশয্যা গ্রহণ করিল।
বৃদ্ধ বয়সে বেদনা শোকে ক্ৰমে মসুর মার শরীর ভাঙ্গিয়া পড়িল। সে একা–নিঃসঙ্গ। তার জীবন বড় বেদনাভরা হইয়া উঠিল।
ঘরের পার্শ্বে আমগাছতলায় তার অতি প্রিয়তম ছোট ছেলে এবং মেয়ের কবর দুটি পাশাপাশি হইয়া পড়িয়াছিল।
সন্ধ্যা যখন বিশ্বে নামিয়া আসিত, মৃদু অন্ধকারে গ্রামের পথে পথে যখন মশকদল বেদনার গান গাহিত, যখন বাড়ি গোয়ালঘরের সম্মুখে কত বছরের বেদনা-স্মৃতি লইয়া সাজালগুলি জ্বলিয়া উঠিত, দারিদ্র গ্রাম্য লোকগুলি উঠানে বসিয়া কত সুখ-দুঃখের গল্প করিত, তখন মসুর মা অন্ধকারে সেই আমগাছতলায় বসিয়া আর্তক্রন্দনে সন্ধ্যা-গগন মুখরিত করিয়া তুলিত। তখন গ্রামের পথগুলি তার করুণ শোকগাথায় মূৰ্ছিত হইয়া পড়িত।
মসুর মার বাড়ির পার্শ্বে এক ঘর মুসলমান সুদখোর মহাজন পরিবারের বাস। তাহাদের অনেক জমাজমি ছিল। জনহিতকর কার্যে তাহাদের কোনো সহানুভূতি ছিল না। মসুর মা তাহাদের প্রজা।
একদিন তাহাদের বড় মিঞা মসুর মাকে ডাকিয়া লইয়া বলিলেন, “দেখ মসুর মা, তুই এখন একা, এত বড় বাড়িখানি দিয়ে এখন আর কী করবি। আমার প্রাচীরটা একটু বাড়ান দরকার। তোর ভিতরের বন্দোবস্ত জমিগুলিও ছেড়ে দে। একা মানুষ, করিম মোল্লার বাড়িতে যেয়ে থাক, ঘর বাঁধবার যা খরচ লাগে তা আমি দেবো”।
মসুর মা আর কী বলিবে?–সে ভবিয়াছিল জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলি আম গাছের তলার দিকে চাহিয়া চাহিয়া কাটাইয়া দেয়, গত জীবনের হাজার স্মৃতি তার বাড়িখানিকে আঁকড়িয়া ধরিয়া আঁখিজলের সহিত সে বেচিয়া খাইবে।
সে দেখিল আঁখিজলের ভিতরেও এতটুকু খোঁজবার অধিকার তার মতো ছোটলোকের নাই। পরের অনুগ্রহে পালিত হওয়াই হবে এখন তার সব দুঃখের প্রতিদান।
বৃদ্ধা আস্তে আস্তে কহিল–“আমার কোনো আপত্তি নাই!” সে কথা বলা ছাড়া তার আর উপায় ছিল না। মসুর মা কয়েকদিনের মধ্যেই করিম মোল্লার বড় ঘরের পাশে একখানা কুঁড়েঘর তুলিয়া লইল। তাহার পর আরও কয়েক বছর কাটিয়া গেল। ক্রমে চোখ দুটি তার নষ্ট হইয়া গেল। বাড়িতে বাড়িতে লাঠি লইয়া ছায়াময় দৃষ্টির সাহায্যে দুইটি অন্নের জন্য সে ঘুড়িয়া বেড়াইত। সাবেক মুনিব বড়মিঞার বাড়িতে সে অনেক সময় যাইত। বড়মিঞার পুত্রবধূ বুড়ির দুঃখ সাধ্যমত দূর করিতে চেষ্টা করিত। পুরোনো কাপড়, মাথার তেল, কখনও পেটে খিদে নাই বলে চুপে চুপে ভাত-তরকারি মসুর মা কানিকে দিত। মাঝে মাঝে মসুর মা মুনিব বাড়ির ইন্দারায় তার কাঁধা ভাঙ্গা মেটে কলসিটা কাকে নিয়ে জল আনিতে যাইত। চঞ্চল হাসিমুখ বৌটি বুড়ির অজ্ঞাতসারে তার কলসিটি নিয়া লুকাইয়া রাখিয়া দিত। অন্ধ বুড়ি উপুড় হইয়া যখন এখানে ওখানে কলস হাতড়াইত, তখন বালিকা হাসিয়া খুন হইত। পাড়ার বৌ-ঝিদের ভুক্তবিশেষ, পোড়া-পচা পান্তা ভাত মসুর মা আগ্রহের সহিত গ্রহণ করিত।
আমকালে যখন তার আম খাইবার সাধ হইত, তখন সে কোনো ভদ্রগৃহে যাইয়া তাহাদের ফেলিয়া দেওয়া ছোবড়াগুলি চুপে চুপে, কুড়াইয়া লইয়া চুষিয়া খাইত। কেউ যদি কোনোদিন পিঠে প্রস্তুত করিত, মসুর মা কোনো রকমে জানিতে পারিলে, সে সেদিন বিনা আহ্বানে তাহাদের পানি তুলিয়া এটা-ওটা করিয়া দিতে চেষ্টা করিত। দয়া করে তারা তার হাতে একখানা পিঠে দেবে, এই আশায় সেদিন তার কোনো জায়গায় আহার হইত না। সেদিন সে সাঁঝের বেলা তার বন্ধু সেই বালিকা-বধূর কাছে যাইয়া দাঁড়াইত। সাঝের মৃদু অন্ধকারে সকলের অগোচরে কানাবুড়ি কি যেন সুদখোর মহাজনের বাড়ি হইতে আঁচলে ঢাকিয়া লইয়া যাইত।
একদিন বর্ষাকালে তার বন্ধু সেই বৌটি তাকে না বলেই বাপের বাড়ি চলিয়া গেল। বুড়ি তার আশায় মাসের পর মাস কাটাইয়া দিয়াছিল কিন্তু আর সে আসিল না।