সুষমা জিভ কাটিয়া বলিল–“আপনাকে শ্রদ্ধা দেখান ভালো দেখায় না!”
রায়হান বলিলেন–“অধিকাংশ স্থলে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর এই শ্রদ্ধা গোপন অসম্মানের সহিত গৃহীত হয়ে থাকে।”
“আচ্ছা, আপনাকে বাইরে শ্রদ্ধা জানাব না। অন্তরে আপনার চরণে নুয়ে পড়তে বাধা নাই।”
“বেশ”–একটু থামিয়া রায়হান জিজ্ঞাসা করিলেন–“আচ্ছা, যে কথা বলেছিলাম, তার কী হল”?
সুষমা বলিল–“কী কথা?”
“সেই বোন-পাতানোর কথা।”
“খুব রাজি–সত্যই করিমা আমার বোন। আমি তার সঙ্গে একেবারে এ হতে পারি–আহারে-আরে সব বিষয়ে।”
“সেরূপ বোন-পাতানোর কথা বলছি না।”
“তবে কিরূপ?”
“তুমি হিন্দু-হিন্দুই থাকবে। করিমা মুসলমান-মুসলমানই থাকবে। শুধু মনের মিল, আর কিছু নয়।”
“আপনার ভাই কে হবেন?”
“সুকুমারকে ভাই করিলাম।”
সুষমা। খুব ভালোই হবে।কিন্তু সব হিন্দু-মুসলমান কি আপনার কথা শুনবে? আপনি তো প্রত্যেক হিন্দু-মুসলমান পরিবারে, এই হিন্দু-মুসলমান প্রথাকে একটি অপরিহার্য সামাজিক সংস্কার করতে চান।”
“কেউ মানবে না তা জানি! বরং পাগল বলে উপহাসিত হবো। এটা আমার মনের গোপন ভাব এবং তা আমি সর্বসাধারণের কাছে প্রচার করতে যাচ্ছি না। আমি,করিমা, তুমি ও সুকুমার–এই চারজনের সঙ্গে এই প্রথার সম্বন্ধ।”
“যদিও আমি বুঝি এবং আপনার কাছে কিছু কিছু শুনেছি তবুও আপনার এই প্রথা সম্বন্ধে নূতন করে বলুন।”
রায়হান বলিলেন–“দেখ সুষমা, কারো কাছে আমি আমার মত প্রচার করে বেড়াচ্ছি না। যে চিন্তা সহজভাবে খেলার মতো আমার মাথায় আসে তাই বলতে যাচ্ছি।” একটু নিস্তব্ধ থাকিয়া রায়হান হাসিয়া কহিলেন–“সুষমা, চিন্তার কথা শুনতে তোমার খুব উৎসাহ তা জানি!”
“দেখ, আমাদের দুই জাতির ভিতরে সদ্ভাব স্থাপনের পথ এইভাবে তৈরি করলে মন্দ হয় না। হিন্দু বা মুসলমান পরিবারে সন্তান ভূমিষ্ট হবার পর নামকরণের সময় তার জন্য একটা ধর্ম-ভাই বা ধর্ম-বোন ঠিক করতে হবে। উচ্চ-স্তরের দশজনের চেষ্টায় এটাকে সকলে সামজিক রীতি বলে গ্রহণ করতে পারে। হিন্দু বালিকা মুসলমান ধর্ম-বোন গ্রহণ করবে,মুসলমান বালিকা হিন্দু ধর্ম-বোন গ্রহণ করবে। পুরুষদের সম্বন্ধেও একই কথা। তারাও ভিন্ন সমাজ হতে ভাই গ্রহণ করবে। কেউ কারো সঙ্গে ভ্রাতৃত্ব সম্বন্ধ স্থাপন করে মৃত্যু পর্যন্ত এই বন্ধনকে সম্মানের চোখে দেখবে। দুই বিরুদ্ধ জাতির মধ্যে সখ্য স্থাপন অসম্ভব। বিবাহপ্রথা ছাড়া কোনো কালে বিভিন্ন সমাজের মধ্যে প্রণয় হয় নাই–অথচ হিন্দু মুসলমানের প্রণয় না হলে চলবে না। উভয়ের বাঁচবার পথ এই।
ঘরের ভিতর হইতে সুকুমারের মা বলিলেন–“তোমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই গল্প করবে?”
রায়হান বারান্দায় যাইয়া উপবেশন করিলেন। সুষমা কহিল–“মা, আমার ইচ্ছে রায়হান ভাইকে খাওয়াই।”
সুষমার মা বলিলেন–“রায়হান যে খায় না?”
রায়হান কুণ্ঠায় কহিলেন–“দেখুন খুড়ি, আমি খাই না বলে আপনারা বোধহয় কষ্ট পান। যদি বুঝতেন মুসলমান হিন্দু বাড়িতে খেলে তার অসম্মান হয়, তাহলে আপনারা কিছু মনে করতেন না।”
সুষমা কহিল–“নগেনের উকিল সাহেবের ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল, সে সপ্তাহে একবার করে তাদের বাড়ি যেয়ে খেতো, আমি জানি, আপনি খাবেন না তাই বলুন।”
“নগেনের কথা বাদ দাও। অনেক হিন্দু অনেক কিছু করে। আমি তা ভালবাসি না। সে যা সে তাই থাক। হিন্দু সে হিন্দুর মতো থাকবে। অনেক হিন্দু কলকাতায় অবৈধ জিনিস কিনে খায়, সে কি ভালো?”
কিছুক্ষণ পরে সুকুমারের মা সুষমাকে সোজাসুজি দূরে যাইতে না বলিয়া বলিলেন–“মা, তোমার দাদার ঘরে যেয়ে একটু পড়ে এসো। এক্ষুনি আবার রান্না করতে যেতে হবে।”
সুষমা উঠিয়া দাঁড়াইয়া রায়হানকে কহিল–“রায়হান ভাই, যাবার সময় না বলে যাবেন না।”
সুষমা চলিয়া গেল তার মা রায়হানকে বলিলেন–“বাবা রায়হান, সুষমার বিয়ে তোমাকেই ঠিক করতে হবে। এই জন্যই তোমাকে ডেকেছি। সুকুমার বিদেশে থাকে। তার কাকারা মেয়ের বিয়ে সম্বন্ধে একেবারে উদাসীন।”
রায়হান–“সুষুমাকে তো বিয়ে দেওয়াই দরকার।”
“যদু বাবুর ছেলে তো বি-এ পাশ করেছে!”
“নিশি!–সে ছেলে মন্দ নয়! তবে তার মাথায় কতকগুলি পাগলামি ঢুকেছে। সে কোনো গুরুর মন্ত্র নিয়েছে। মাছ-মাংস খায় না। বিয়ে করে তার স্ত্রীকে নাকি ব্রহ্মচারিণী রবে।”
রায়হান হাসিয়া বলিলেন–“পাছে পিপীলিকার ঘাড়ে পা লাগে এই ভয়ে সে গাছের ডালে এক ঘর বেঁধে সেখানেই বাস করে। তার আর এক উদ্দেশ্যে পাখির সরলতা অনুকরণ করা। সে বলে–সংসারের সঙ্গে তার কোনো সম্বন্ধ নাই। সমস্ত বিশ্বের মানুষ অন্ধকারে পড়ে আছে–সে সকলকে তার আলোকে টেনে তুলবে! সারাদিন সে চোখ বুজে বসে থাকে–পাপ পৃথিবীর পানে সে তাকায় না। দুঃখেই ভগবানকে নাকি পাওয়া যায়, এই জন্য সে সেই উচ্চস্থান থেকে মাটিতে লাফিয়ে লাফিয়ে পড়ে।
বিস্ময়ে সুষমার মা বলিলেন–“নিশির এই অবস্থা হয়েছে? থাক দরকার নাই। আমার ইচ্ছা তুমিই পছন্দ করে সুষমাকে বিয়ে দাও।”
সুষমার বিবাহ ব্যাপার, জমাজমি সংক্রান্ত কতকগুলি পরামর্শ, সুকুমারের ভবিষ্যৎ জীবন সম্বন্ধে কথা কহিয়া রায়হান বাড়ির দিকে চলিলেন।
.
দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ
রায়হানের বাড়ি হইতে বেশি দূরে নয়, ওমেদপুরের উত্তর পাড়ায় দুঃখিনী মসুর মা বাস করে। চোখ খোলা থাকিলেও সে কিছু দেখিতে পায় না। শুধু অভ্যাসের জোরে গ্রামের পথ দিয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়ায়।