বই বাঁধাই শিখিবার জন্য একজন যুবকের কলিকাতা যাওয়া আবশ্যক। মেয়েদিগকে কাঠের কাজ শিক্ষা দিবার জন্য একজন যুবককে কোনো আর্টিজন স্কুলে পাঠাইব। যা কিছু খরচ লাগিবে,সবই তিনি আশ্রম হইতে পাইবেন। ছাত্রীরা অস্ত্র ব্যবহারে এবং কাঠের কাজে সুদক্ষ হইয়া উঠিলে পুরুষ শিক্ষকের প্রয়োজন হইবে না। মেয়ে-শিক্ষক পাইলে আর কারও সাহায্য চাহিতাম না।
হামিদের পিতা এবং গ্রামস্থ অন্যান্য ভদ্রলোক আগ্রহের সহিত আশ্রমের সম্বন্ধে বক্তৃতা করিলেন।
করিমার শ্বশুর ভিন্ন গ্রাম হইতে সভায় যোগদান করিয়াছিলেন। তিনি ওজস্বীতাময় বক্তৃতা দিয়া সকলকে প্রতিজ্ঞা করাইলেন, আশ্রমকে এক শক্তিশালী কেন্দ্র করিতে তাহারা বদ্ধপরিকর হইবেন। আশ্রমের সঙ্গে সঙ্গে একটা মাইনর স্কুলেও চলিবে। গ্রামের সকল বালিকা-ইতর কি ভদ্র-বিদ্যালয়ে যোগদান করিবে এবং শিল্প করিয়া তাহারা জীবনকে নিরাপদ করিয়া লইবে।
দুইজন যুবক কহিলেন–আমরা আমাদের ভগ্নিদের শিল্প শিক্ষার্থে বিদেশে যাইতে প্রস্তুত আছি। রমণীর দুঃখ অসহনীয়। নারী বিপদে পড়িয়া অনিচ্ছায় পথে দাঁড়ায়। তাহাদিগকে আশ্রয় দিতে হইবেই। পাপী পুরুষকে উদ্ধার করিবার জন্য বহু মানুষ ব্যস্ত, নারী বলিয়াই নারীর সম্মুখে দুর্লঙ্ঘ্য বাধ তুলিয়া ধরা ঠিক নহে।
.
বিংশ পরিচ্ছেদ
দোকানের কাজে ক্রমশ উন্নতি হইতেছিল। অন্যান্য জিনিস বিক্রয়ের সঙ্গে চারজন দর্জি কাজ করিয়াও কুলাইয়া উঠিতে পারে না।
সন্ধ্যার পর রায়হান দোকান ঘরে বসিয়া খবরের কাগজগুলি দেখিতে ছিলেন। এমন সময় সুকুমার আসিল।
রায়হান মৃদু হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন–“কবে বাড়ি এলে, সুকুমার?”
সুকুমার উত্তর না দিয়াই রায়হানের পদধূলি গ্রহণ করিবার জন্য মাথা নত করিল। রায়হান যুবকের হাত ধরিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া প্রীতির সহিত কহিলেন–“ভেবেছ তুমি আমার পদধূলি গ্রহণ করতে পারবে। তোমাকে এত ব্যক্তিত্বহীন করে পাপ করাইতে চাই না। অমন করে নিজেকে হারিয়ে ফেলো না। তুমি জান না, ইসলাম কাকেও ব্যক্তিত্বহীন করতে চায় না? নত মাথা অপেক্ষা নত মন জ্ঞানীর চোখে সমধিক প্রিয়। অনন্ত মানুষকে মুক ও বধির করে একা বেঁচে লাভ কী?” সুকুমার। আপনি দেবতা, আমার মাথা আপনা আপনি আপনার পায়ের কাছে নত হয়ে পড়ে।
রায়হান–ঐ কথা বল্লে আমাকে অপমান করা হয়।
সুকুমার-আপনার অনুগ্রহে বেঁচে আছি। আপনাকে সম্মান করব না,কাকে সম্মান করব?
রায়হান–ভুল বুঝেছ! মাসে মাসে ১০টি করে টাকা পাও বলে আমরা কাছে তোমাকে হীন হতে হবে? দানের দ্বারা তোমার মনকে ছোট করতে চাই না। যদি তুমি ভয় কর, তা হলে তোমার স্টাইপেণ্ড আমি বন্ধ করব! ছোটকাল হতে এই হীন বিনয়ের জন্য তোমাকে ভালবাসি নাই। তোমার মৃতদেহ আমি চাই না–আমি চাই তোমার সকল জীবন-ভরা বিকাশ।
সুকুমার বলিল–“আমায় ক্ষমা করুন–শিক্ষা হয়েছে।” তাহার পর চৌকির উপর বিক্ষিপ্ত বইগুলির উপর তাকাইয়া বিস্ময়ে কহিল–“একি দাদা! বাংলায় সকল মাসিক যে আপনার কাছে! আমাদের কলেজ লাইব্রেরিতে মাত্র দুইখানি বাংলা পত্রিকা আসে। আর সব ইংরেজি। বড় কঠিন কিছু বুঝি না। দুই এক পাতা বুঝলেও ধৈর্য ধারণ করে বেশি পড়তে পারি না।”
রায়হান বলিলেন–“বিদেশী ভাষা, সে সব পড়ে মানুষ হওয়া কঠিন কাজ,জ্ঞানী মাত্রেই স্বীকার করবেন। শক্ত বলে বড় সহিত্যকে অবহেল করতে বলছি না। তবে দেশের প্রত্যেক লোককে বিদেশী সাহিত্য আলোচনা করতে হবে এরূপ ব্যবস্থা করা ঠিক নয়।”
সুকুমার কহিল–“যাদের সহিত্য নাই তারা খুব বড় হবে কী করে?”
রায়হান বলিলেন–“কতকগুলি লোক বেদেশী সাহিত্য থেকে রত্ন চয়ন করে জাতীয় শক্তি বৃদ্ধি করবেন। সাহেবেরা ২৪ ঘণ্টা বই পড়ে; তার অর্থ তারা তাদের মাতৃভাষায় আনন্দ লাভ করে।
বাঙালির যদি উন্নত সাহিত্য থাকত তারাও রাস্তা-ঘাটে জ্ঞান আলোচনা করতো। আইন প্রণয়ন ও সংস্কার সাধনের চিন্তা অপেক্ষা দেশী সহিত্য-উন্নতির কথা অধিক করে সরকারের ভাবা উচিত। তা হলে শাসনের উদ্দেশ্য অনেক আগে সিদ্ধ হয়।”
রায়হান জিজ্ঞাসা করিলেন–“অধ্যাপকেরা যে বক্তৃতা করেন তা তুমি কেমন বোঝ?”
সুকুমার আমার সন্দেহ হয় তাঁরা মুখস্থ করে এসে কথা বলেন–বক্তৃতা কালে তাঁদের অনেকেরই চিত্তের সহজ ভাব থাকে না। পাছে অধ্যাপক লজ্জা পান, এই ভয়ে কোনো কথা জিজ্ঞেস করি না। রায়হান বলিলেন–“মনের সহজ ভাব না থাকলে শ্রোতাকে সন্তুষ্ট করা যায় না। যদি বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দেন তা হলে ভালো হয়। কথা ভিতর দিয়ে নিজেকে ভালো করে প্রকাশ করা যায়।”
২১-২৫. ভিন্ন গ্রাম হইলেও
একবিংশ পরিচ্ছেদ
ভিন্ন গ্রাম হইলেও নিকটেই সুকুমারের বাড়ি। তাদের অবস্থা আগে খুব ভালো ছিল। পুরোনো দালানখানি তার সাক্ষী। প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া সুকুমার যখন অভাবে পড়া ছাড়িয়া দিতে চাহিয়াছিল,তখন রায়হান তাহার মাকে বলিয়াছিলেন–“খরচ আমি দিব।”
সুকুমার রায়হানকে শ্রদ্ধা করে। তার অন্তরের এই পূজা অর্থের জন্য কিছুতেই নয়।
পরের দিন সন্ধ্যাবেলা রায়হান সুকুমারদের বড়ি যাইয়া উপস্থিত হইলেন। ছোট পরিবার–তার মা আর একটা ছোট বোন, নাম সুষমা। সবে তার বিবাহের সূচনা হইয়াছে। সে বুদ্ধিমতি এবং বই পড়িতে পারে।সুষমা নত হইয়া রায়হানকে প্রণাম করিল। রায়হান কহিলেন, “মানুষ হইয়া মানুষের কাছে মাথা অবনত করতে নাই।” ভিন্ন ধর্মাবলম্বীকে অধিক শ্রদ্ধা দেখান ভালো দেখায় না।”