রামচরণ শরতের মাথায় একটা প্রচণ্ড ঘুষি লাগাইয়া কহিল, “শালা, তোর হেঁয়ালী ফেলে রাখ। টাকা দিতেই হবে। প্রত্যেকের নিকট হতে ১০০ টাকা করে রাত্রেই চাই।”
বলাই শরতের টুটি ধরিয়া তার গোটা শরীরটা শূন্যে তুলিয়া ফেলিল। বন্ধ মুখের মধ্যে একটা গভীর বেদনাব্যঞ্জক শব্দ কাঁপিয়া উঠিল। শরৎ বেদনায় কাঁদিয়া উঠিল।
এক-এক করিয়া বাকি তিনজনকেও সেখানে আনা হইল। কিল, ঘুসি, লাথি ও অপমানের অত্যাচারে শরৎ এবং তাহার বন্ধুত্রয় শেষকালে স্বীকৃত হইল ৫০ টাকা করিয়া মোট দুইশত টাকা সেই রাত্রেই তাহারা হাজির করিবে, নহিলে তাহারা বুঝিল, চুরির অপরাধে তাহাদের ভাগ্যে জেল অনিবার্য।
বন্ধু তিনজনকে সেখানে রাখিয়া শরৎ টাকা আনিতে গৃহে গমন করিল।
রাত্রি তখন ৩টা। শীতে কয়েদিরা গারদঘরে কাঁপিতেছে, এমন সময় ছোট দারোগা গরম ওভারকোট ও শালে সর্বাঙ্গ জড়াইয়া সেই পথ দিয়া বাসায়া ফিরিতেছিল।
সিপাই তিনজন মনের আনন্দে গঞ্জিকা সেবন করিতেছিল। খোরশেদ রুক্ষস্বরে জিজ্ঞাসা করিল–“বাবুদের ছেড়ে দিয়েছিস? যাবার সময় দুই চার আনা বকশিস্ দিয়ে দিয়েছেন তো।”
জনার্দন সহসা খোরশেদের কানের কাছে আসিয়া চাপা গলায় কহিল–“বাবু দুই চার আনা নয়! দুশো টাকা আদায়ের ব্যবস্থা করেছি। সে কি আর সহজে, ঘায়ের চোটে শালাদের নাক দিয়ে রক্ত বের করে ছেড়েছি। এক জন টাকা আনতে গিয়েছে। বাকি তিনজন গারদঘরে।”
“ওরে শালা!’ বলিয়া খোরশেদ জনার্দনকে লাথি মারিয়া কহিল–“পুলিশে কাজ কর বলে কি পশু হয়েছ? অপরাধটা কি যে তাদের উপর এই অত্যাচার? কী করেছে তারা, যে। এই টাকা? আন্ শালা-চাবি আন এখনি। গারদঘর খুলে ভদ্রলোকদের যেতে দে। ছিঃ! ছিঃ!–এই দারুণ শীতে!”
জনর্দান তাড়াতাড়ি গারদ ঘর খুলিয়া দিল।
.
ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ
খোতবা পাঠ করিয়া রায়হান কহিলেন–“আমাদের আশ্রমের পূর্ণ সাফল্যের জন্য কয়েকজন যুবককে বাহিরে যাইতে হইবে। সেই চারজন যুবকের চিন্তা নতুন ধরনের হওয়া চাই। চাকরি যারা করে তারাই ভদ্রলোক, বাকি লে ক সব ছোট,–এরূপ যাহারা ভাবে তাদের দ্বারা কাজ হইবে না। তাদের জানা চাই–জ্ঞী মানুষ যদি সামান্য কাজও করেন তাবে তার মর্যাদা কমবে না। আমি চাই সত্যের সেবক–সে নীচাশয় ও সঙ্কীর্ণ হৃদয় হইবে না। সে বিশ্বাস করিবে মানুষের মর্যাদার ভিত্তি মনুষ্যত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত।
আমাদের শিক্ষালয়ে চল্লিশজন মহিলা আশ্রয় পাইয়াছে। করিমা খাতুন কোরান ও বাংলা শিক্ষা দেবার ভার লইয়াছেন। দুইটি সেলাইয়ের কল চলিতেছে। আমি নিজে তাহাদিগকে সেলাই শিখাইয়া থাকি।
আবুল কাসেম মিঞার একটি কন্যা, যুবতী বয়সে তিনটি পুত্রসহ বিধবা হন। তিনটি পুত্রই কলেরা রোগে প্রাণত্যাগ করে। বিমাতার গর্ভজাত ভাইরা তাহাকে সংসার হইতে তাড়াইয়া দেয়। একান্ত নিরাশ্রয় হইয়া অতি দুঃখে বালিকা এক ধনীর গৃহে আশ্রয় ভিক্ষা করে, কিন্তু তাহারাও তাহাকে কোনো কারণে স্থান দেন নাই। অতি দুঃখে, অতি বেদনায় এ কৃষকের ঘরে তাহার কাল কাটিতেছিল, আশ্রম তাহাকে গ্রহণ করিয়াছেন–শীঘ্রই সে। মাসে ত্রিশ টাকা পর্যন্ত উপায় করিতে পারিবেন।
এক হিন্দু জমিদারের পুত্রবধু গঙ্গাস্নানে গিয়াছিলেন। রান্নাঘাটের কতকগুলি বদমাইস ব্রাহ্মণ ভিড়ের ভিতর হইতে তাহাকে নিতান্ত নিরুপায় করিয়া ফেলে। যুবতীর আঁখিজল পাষণ্ডদের হৃদয়ে কৌতুক দিয়াছিল মাত্র। তাহারা যুবতীর সতীত্ব হরণ করে। সে অনেক কথা–তিন বৎসর পরে সে আমাদের আশ্রমের সন্ধান পাইয়া আশ্রয় ভিক্ষা করে। তাহাকে সেলাইয়ের কাজ শিক্ষা দিতেছি। শীঘ্রই সে স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করিবার শক্তি লাভ করিবে। কোনো পিশাচের কৃপার পাত্র হইয়া তাহাকে থাকিতে হইবে না। স্বামী তাহাকে গ্রহণ করিবে কি না–এ প্রশ্ন তুলিবার কোনো আবশ্যকতা নাই।
৩বাহার বলিয়া একটি বিংশ বর্ষীয়া কৃষক যুবতী একটি কন্যা লইয়া পথে পথে ঘুরিত। ছয় বৎসর আগে তাহার স্বামী আসামে চলিয়া গিয়াছিল। মেয়েটির না ছিল অন্ন, না ছিল বস্ত্র। দুষ্ট বদমাইসের দৃষ্টি তাহার কাছে নিতান্ত অসহনীয় হইয়া উঠিয়াছিল। পুরুষ কিন্তু রমণী জাতের এই দীনতা ও ক্ষুধা সহ্য করিবার পরিবর্তে যে কোনো পাপ করিতে পারে। সেই যুবতাঁকে আমরা গ্রহণ করিয়াছি। ইচ্ছা করিয়াছি তাহাকে পুস্তক বাঁধাই শিখাইবাসে বিধাতার রাজ্যে বাঁচিয়া থাকিতে পারিবে।
কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ থাকিয়া রায়হান আবার বলিলেন–একজন যুবককে কলিকাতার বয়ন-বিদ্যালয়ে পাঠাইতে চাই। সে ফিরিয়া আসিয়া ছাত্রীদিগকে বস্ত্রবয়ন শিক্ষা দিবে। প্রস্তুত কাপড় আমারাই পরিব। দেশের বহু নরনারী অনাহারে মরিতেছে, তাহাদিগকে আহার দিয়া বাচাইবার জন্য মানবের মঙ্গলকামী সহৃদয় দেশবাসীকে যদি একটু বিলাস পরিত্যাগ করিতে হয় তাহা তাহাদিগকে করিতে হইবে।
বস্ত্রবয়নে কোনো ছাত্রীর সম্মানহানি হইবে না। জোলা বলিয়া এসলামে কোনো স্বতন্ত্র জাতি নাই। একথা যিনি অবিশ্বাস করিবেন তিনি অন্যায় করিবেন। কোনো কর্মই বিশেষ করিয়া কতকগুলি লোকের জন্য হইতে পারে না। বাংলার হিন্দু-মুসলমান ছাড়া অন্য কোনো জাতির ভিতর এ নিয়ম নাই।
দেশের মানুষ যদি দেশের জিনিসপত্র ব্যবহার করিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় তাহা হইলে বহু মানুষকে সাহয্য করা হয়। ভাইকে সাহায্য করা কি ইসলাম গর্হিত কাজ মনে করে? কত টাকা বিদেশে চলিয়া যাইতেছে। এই টাকার মালিক যদি আমরাই হইতাম, তাহা হইলে, আমাদের সমাজ অনেক আগে শক্তিশালী হইয়া উঠিত। অর্ধাশনে ও অনশনে থাকিয়া বিদেশী বিলাস দ্রব্যে আত্মাকে শীর্ণ ও প্রাণহীন করিয়া সুন্দর হইতে চাহিতেছি।