“অন্তত ৩০ টাকা।”
এই সময় খোরশেদ সিপাই-এর এবং সাধারণের উড়ো কথার সাহায্যে বদমাইসদের খোঁজ লইতেছিল।
জগদ্বন্ধু খুড়ির সহিত বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিল।
ঘরের মধ্যে একটা পুরোনো বাক্স, তার নিচে আর একটা বাক্স, তার নিচে একটা পেটরা! একে একে বাক্সগুলি নাবাইয়া রমণী সেই পেটরাটি খুলিয়া ফেলিল। কতকাল সেটা সেখানে ছিল!
একধারে একটা ছোট বাটার ভিতর হইতে সে একছড়া ঝকঝকে হার বাহির করিল। জগদ্বন্ধু আগ্রহে হাত বাড়াইয়া কহিল–“ঐ বালা দুগাছিও বাইরে রাখ!”
বিধবা জগদ্বন্ধুর হাতে হার রাখিয়া অস্পষ্টভাবে বলিল–“এই বালা আর এই হার গড়াতে তোমার খুড়োর দুশো টাকা লেগেছিল। এই হচ্ছে তোমার কাকার স্মৃতিচিহ্ন।” বিধবার চোখ জলে ভরিয়া উঠিল।
জগদ্বন্ধু শান্তভাবে বলিল–“বিপদের সময় তোমাকে ফেলতে পারি না। খুড়ি, আমিই এই হার আর বালা নিচ্ছি। অন্যলোক হলে ২৫ টাকার বেশি দিতাম না। তোমাকে ৫০ টাকাই দিব।”
জগদ্বন্ধু হার ও বালা হাতে লইয়া কহিল–“খুড়োর কথা বলো না খুড়ি। অমন লোক আর হয় না। ভাগ্যে তোমার জন্য গহনা দুখানা রেখে গিয়েছিলেন–নইলে এ বিপদের সময় কী হতো?”
জগদ্বন্ধু হার ও বালা লইয়া গিয়া বাড়ি হইতে টাকা লইয়া আসিল। সিপাইকে একপার্শ্বে ডাকিয়া আনিয়া হাতে ৫ টাকা দিয়া কহিল,–“এক টাকা আপনার এবং বাকি চার টাকা দারোগা বাবুকে দিবেন।”
সিপাই হাসিয়া জগদ্বন্ধুকে সালাম করিয়া কহিল–“আপনারা কিছু না দিলে আমরা কী করে বাঁচি? আপনারা ভদ্রলোক কিনা! দুই-এক চশমখোর আছে, তাদের হাতে একটা পয়সাও গলে না।”
অতঃপর খোরশেদ সিপাহী তিনজনকে লইয়া সোজাসুজি ঠাকুরবাড়িতে আসিল। গদির উপর চারিজন হিন্দু তাস খেলিতেছিল। খোরশেদ কাহাকেও কিছু না বলিয়া ঘাম সিক্তকলেবরে তাহাদের পার্শ্বে ফরাসের উপর যাইয়া বসিল।
খেলোয়াড়দের একজন তখন তামাক খাইতেছিল। তাড়াতাড়ি সে কাটি ত্যাগ করিয়া কহিল–“দারোগা হলেও কারও ধর্মে হাত দিবার আপনার কোনো অধিকার নাই।”
বিস্মিত হইয়া খোরশেদ বলিল–“নিশ্চয়ই! কে কার ধর্মে হাত দিল?”
“এই তো হুঁকার জল নষ্ট করলেন!”
খোরশেদের অগোচরে একজন ইশারা করিয়া মৃদু চাপা স্বরে কহিল–“দারোগা হলে কী হবে? মুসলমান তো!”
সিপাই জনার্দন তাহা শুনিয়াছিল। ক্রুদ্ধ সর্পের ন্যায় তার বাবুর দিকে চাহিয়া সে কহিল–“শুনেছেন বাবু, হুকুম দেন, বেটার কান ধরে ঠিক করে দিই।”
শরৎ তাস ফেলিয়া সিপাইদের উপর উগ্র হইয়া কহিল–“কি রে বেটা,–পাজি। ভদ্রলোকের মর্যাদা বুঝি না?”
জনার্দন পশুর মতো কহিল–“সাবধান, শূয়ার কা বাচ্চা।”
শরৎ স্বপ্নেও ভাবে নাই, সামান্য একজন ৭ টাকার অশিক্ষিত সিপাই তাহাকে এরূপভাবে সম্বোধন করিবে। অন্তরের অন্তঃস্থল হইতে জনার্দনকে অভিসম্পাত করিয়া সে নির্বাক কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
খোরশেদ উঠিয়া দাঁড়াইয়া সহসা নিষ্ঠুরভাবে কহিল–“জনার্দন, রামচরণ, বলাই! আচ্ছা, তা হলে তোমরা এদের চারজনকেই বেঁধে থানায় নিয়ে এস।”
মেনু চৌকিদার এক পাশে দাঁড়াইয়াছিল। সহসা খোরশেদ তাহার পার্শ্বে লাথি মারিয়া বলিল–“বেটা হারামজাদা! দাঁড়িয়ে আছিস যে-পাকড়ো।”
সিপাই তিনজন এবং মেনু চারজনকেই গ্রেপ্তার করিল।
ব্যাঘ্র খাঁচায় পড়িলে যেমন সে গর্জিয়া উঠে, শরৎ এবং তাহর বন্ধুগণ তেমনি গর্জিয়া কহিল–“দেখ দারোগা, ঘুঘু দেখেছ ফাঁদ দেখ নাই। পাড়া গাঁয়ের হাবা পেয়েছ, কেমন? আমরাও আইন-কানুন জানি। বলি, আমাদের অপরাধ কী, দারোগা?”
খোরশেদ কহিল–“ষাড় চুরি করবার মজা টের পাবে!”
শরৎ ঘৃণায় মাটির উপর পদাঘাত করিয়া কহিল–“রাম! রাম!”
“হিন্দু হয়ে যাড় জবাই করে খেয়েছ সে কথা না বল্লেও তোমরা যে ষাঁড় অপরের কাছে বিক্রয় করেছ তার প্রমাণ আছে।”
জনার্দন শরতের ঘাড়ে ধাক্কা দিতে দিতে বাইরে আনিল।
তখন প্রায় সন্ধ্যা হইয়া আসিয়াছিল। বড় দারোগা থানায় ছিলেন না। খোরশেদ যথাসময়ে গারদঘরে চারিজনকে আটকাইয়া বাহিরে আসিয়া জনার্দনকে একপার্শ্বে ডাকিয়া আনিয়া মৃদুস্বরে কহিল–“শীতের রাত্রি, গোটা তিনেক টাকা আদায় করে খানিক পরেই ছেড়ে দিও, তাতেই শিক্ষা হবে। আমি একটু বাইরে চল্লাম। ঘোড়ায় চড়ে গায়ে ব্যথা হয়েছে, একটু স্টিমুলেন্ট না হলে চলছে না।”
সন্ধ্যার তিনঘণ্টা পরে জনার্দন, রামচরণ ও বলাই আয়েস-আরামের সহিত আহারাদি করিয়া শরৎকে নিঃশব্দে গারদঘর হইতে এক অন্ধকার প্রকোষ্ঠে লইয়া গেল।
জনার্দন কহিল–“দেখ বাবু, তোমাদের মাথার উপর কী বিপদ তা বুঝতে পাচ্ছ তো। সাক্ষী প্রমাণ ঢের আছে। আমরা এক-এক করে খাড়া করবো। দারোগা সাহেবকে প্রত্যেকে কিছু কিছু করে নজর দাও, তাহলে সব মুস্কিল আসান হয়ে যাবে।”
শরৎ–তোমরা আমাদিগকে বোকা পেয়েছ। দারোগার বাবা এলেও টাকা দিচ্ছি নে। মিথ্যা করে ভদ্রলোকদিগকে নাকাল কল্লে কী হয় তা পরে টের পাবে। তোমরা তো গরু, তোমাদিগকে আর কি বলবো। দেশের মানুষ হয়ে দেশের মানুষের বুক চিরে টাকা সংগ্রহ করিস, এর ফল আছে–আজ হোক, কাল হোক মূক-শক্তিহীন দেশের মানুষ একদিন না একদিন অত্যাচারী বিশ্বাসঘাতক রাজকর্মচারীর কাছে এর জবাব চাবেই চাবে। অত্যাচার করে সেরে যাবে কদিন? মহামান্য রাজা কি এ জন্য তোমাদিগকে নিয়োগ করেছেন? তোরা তো দেশের মানুষের চাকর। মুনিব চিরকাল ভৃত্যের অত্যাচার সহ্য করবে না।