খোরশেদ–আমার প্রেমের প্রতিদান হবার কোনো আশা নাই, তবে আমি পর স্ত্রীর প্রতি আসক্ত নহি।
ফকির–কেন, এসলামীয় প্রথামত সামাজিক রীতি-পদ্ধতি অনুযায়ী তাকে লাভ, করিবার জন্য চেষ্টা করতে পার না?
খোরশেদ–তিনি আমাকে ভালবাসেন না ভালবাসবারও কোনো আশা নাই। হৃদয়ে অনুদিন অসীম জ্বালা অনুভব করি।
ফকির–যে তোমাকে ভালবাসে না, জোর করে তার ভালবাসা লাভ করতে যাওয়াও মূর্খতা এবং নিজের পক্ষে অপমানজনক। ব্যর্থ জীবনের বেদনা নিয়ে বাঞ্ছিতাকে দূর হতে সম্রম ও শ্রদ্ধার সহিত নমস্কার করে খোদার পথে নেবে পড়। খোদার পথে অসীম শান্তি পাবে। আত্মা তোমার সম্পদশালী হয়ে উঠবে। জোর করে কাকেও পেতে আশা করো না। তার অগোচরে নিজেকে বিক্রয় কর–ত্যাগে আত্মা তোমার বিরাট ও মহান হয়ে উঠবে।
খোরশেদ–আপনার কথা মেনে নেওয়া শক্ত। বুঝিতেছি না বলেই শক্ত। জোর করে কাকেও ভালবাসতে বাধ্য করা পাপ। আপনি ঠিক বলেছেন।
ফকির–তুমি যার জন্য পাগল তিনি হিন্দু না মুসলমান? খোরশেদ–যদি বলি হিন্দু, তাহা হলে কি আপনি সুখী হবেন?
ফকির–ছিঃ, এমন কথা বলছো! মুসলমান হিন্দু নারীর প্রেমে মুগ্ধ? এ-কথা বলতে লজ্জা হয় না?
খোরশেদ–ক্ষমা করবেন–আমি কোন হিন্দু নারীকে ভালবাসি নাই।
খানিক নীরব থাকিয়া খোরশেদ জিজ্ঞাসা করিল–মহাত্মন! কারো সঙ্গে কথা না বলে এমনভাবে জীবন যাপন করেন কেন?
সাধু বলিলেন–নিজের মহিমায় নিজে বিভোর হয়ে স্বাধীনচিত্তে বিশ্ববক্ষে ঘুরে। বেড়াই। মানুষের সঙ্গে সম্বন্ধ কাটিয়ে সদা স্বাধীন মাথা খোদার সামনে নত করি।
.
অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
ক্রমে খোরশেদ উচ্ছল হইয়া পড়িয়াছে। সে সুরা সেবনের নিজের শরীর ও মানুষের উপর অত্যাচার করিয়া দিনগুলি কাটাইয়া দিতেছিল।
সেদিন একটু একটু করিয়া বৃষ্টি পড়িতেছিল। খোরশেদের মস্তিক কখনও মদের নেশায় চঞ্চল। ঘোড়ায় তীক্ষ্ণ কষাঘাত করিয়া খোরশেদ সেই বৃষ্টির ভিতর বাহির হইল।
প্রায় দুই ক্রোশ পথ অতিক্রম করিয়া সে এক হিন্দু পল্লীতে আসিয়া উপস্থিত হইল। বাড়িগুলি বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। সব বাড়িতেই এক-একটা তুলসী গাছ।
সে একখানা ছোট কুটির সম্মুখে আসিয়া অশ্ব হইতে অবতরণ করিল? কুটিরখানি এক বিধবা স্ত্রীলোকের। দারোগা বাবুকে দেখিয়া সে তাড়াতাড়ি বাহিরে আসিয়া একেবারে গড় হইয়া প্রণাম করিল।
খোরশেদ জিভ কাটিয়া কহিল–পাপ!–আমি হিন্দু নই। মুসলমান কাহারও সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত গ্রহণ করে না রমণী! ইহাতে খুশি না হয়ে বিরক্ত হলাম।
গ্রামের যিনি প্রধান তাহার হুকুমে একখানা চেয়ার আসিল। সাধারণ লোক, দুইজন সিপাই, তিনজন চৌকিদার এবং বিধবার কয়েকজন হিন্দু প্রতিবেশী খোরশেদকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল।
খোরশেদ রমণীকে জিজ্ঞাসা করিল–কবে তোমার ঘরে চুরি হয়েছে? সে কাঁদিয়া কহিল–বাবা! তুমি ধর্মাবতার! তুমি যদি আমাদিগকে রক্ষা কর, তা না হলে আমরা দরিদ্র প্রজা বাচি না! আমার মেয়ের কপালে যে কি আছে তা কে বলতে পারে? সে অনেক দিনের কথা বাবা! আমার উমাতারার বয়স ষোল বছর। এই ষোল বছর হল কালীর নামে ষাড় ছেড়ে দিয়েছি। আহ! ওরে সর্বনেশেরা! ওরে পোড়ারমুখোরা! কে এমন ভরা-পড়া কাজ কল্লি রে?
খোরশেদ–এখন শাপ দিয়ে কোনো লাভ হবে না। তুমি কার উপর সন্দেহ করো তাই বলো।
বৃদ্ধা যাদের উপর সন্দেহ করি তাদের নাম করবার যো নাই গো! তা হলে আমার মাথা কাটা যাবে–তুমি যা জান বাবা তাই করো। কোনো হিন্দু আমার ষাড় খায় নাই।
খোরশেদ–বিশ্বাস কী? অনেক হিন্দু আজকাল মুরগি খাওয়া আরম্ভ করেছেন, গরু খেতে আর বাকি কী?
রমণী সহসা ক্রুদ্ধ হইয়া কহিল–কোথাকার দারোগা তুমি?–রাম! রাম!
খোরশেদ কোনো কথা কহিল না। শেষে কহিল–দেখো বুড়ি, আমার বিশ্বাস নিজের ষাঁড় তুমি নিজেই বিক্রয় করেছ। সমাজের চোখে ধুলো দিবার জন্যে তোমার এই কারসাজি। মিথ্যে মোকদ্দমার জন্য তোমাকে ২১১ ধারায় দেওয়া হবে।
রমণী কাঁদিয়া খোরশেদের সম্মুখে ভূমিতে মাথা ঠেকাইয়া কহিল–“দোহাই বাবা! আমাকে রক্ষা কর। আমাকে রক্ষা করবার জন্যেই ভগবান তোমাকে পাঠিয়েছেন। আমি কিছু জানি নে বাবা, আমি কিছু জানি নে। যাক আমার ষাড়, কোনো প্রতিকারে আমার কাজ নেই। শুধু আমাকে রক্ষা কর।”
সিপাই একজনের ইঙ্গিতে, রমণী একজন ধোয়া কাপড়পরা হিন্দুকে লইয়া আঙ্গিনার এক পার্শ্বে গেল।
সিপাই আস্তে অথচ কঠিন উগ্রতায় কহিল–“বেটি, ২০টি টাকার যোগাড় দেখ।”
নাম তার জনার্দন। মুনিবের চাকর জনার্দনের উগ্র চোখের দিকে চাহিয়া স্বজাতির প্রতি সহানুভূতির আশায় হিন্দু ভদ্রলোকটি কহিলেন–“কিছু দয়া হবে না, সিপাই বাবু।”
সিপাই কহিল–“চুপ, দারোগা বাবুকে কিছু নজর না দিলে হচ্ছে না।” এই কথা বলিয়া সে সেখান হইতে সরিয়া গেল।
রমণী ভদ্রলোকটির হাত ধরিয়া কহিল–“তা হলে কি করি বাবু?”
চিন্তা করিয়া সহানুভূতিমাখা স্বরে ভদ্রলোক বলিলেন,–“গহনাপত্র কিছু আছে? কিন্তু কে এখন টাকা দেবে? খানিক নিস্তব্ধ থাকিয়া ভদ্রলোক আবার বলিলেন–যাক, বিপদকালে সবাই তোমাকে ফেল্লেও আমি তা পারব না খুড়ি।”
বৃদ্ধা চোখের জল ফেলিয়া কহিল–“এস জগদ্বন্ধু এস, বাড়ির ভিতর এস। স্বামীর কালের দুইখানা গহনা ছিল–সোনার। দাম দু’শ টাকা হবে। দারোগাকে কয় টাকা দিতে হবে?”