আমেনার বসন সিক্ত। ধীরে ধীরে তাহার নিশ্বাস পড়িতেছিল।
মেঝের উপর পাটি পাতিয়া মা মেয়েকে শোয়াইলেন। রায়হান পার্শ্বে বসিয়া বাতাস করিতে লাগিল। নফিসা আমেনার মুখের কাছে মুখ লইয়া কাঁদিয়া কাঁদিয়া ডাকিতে লাগিলেন–“মা আমেনা! মা আমেনা!”
কিয়ৎকাল পরে আমনো চক্ষু মেলিল। রায়হান জিজ্ঞাসা করিল–“কী আমেনা এমন করে চেঁচিয়ে উঠলি যে?”
বালিকা মৃদুস্বরে কহিল, দুপুরবেলা ভাইয়ের ছিপ নিয়ে ডোবায় ফেলে এসেছিলাম। ভাই এখন ‘ছিপ ছিপ’ করে চেঁচিয়ে উঠলো, তাই আনতে গিয়ে দেখলাম একটা সাদা মানুষ বাঁশঝাড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে।”
খোরশেদ এতক্ষণ চুপ করিয়া তামাসা দেখিতেছিল। ছিপের সন্ধান পাইয়া সে বিরক্তির সহিত জিজ্ঞাসা করিল–“কিরে পাজি, তুই ছিপ নিয়েছিলি?”
নফিসা রুক্ষস্বরে বলিলেন–“পাজি, নচ্ছার, বের হ বাড়ি থেকে।” শুধু এই বলিয়াই তিনি নিরস্ত হইলেন না। তাহার পিঠে একটা চড় লাগাইয়া দিলেন।”
.
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
রায়হানের বয়স পঁচিশের বেশি হইবে না। গ্রামের প্রান্তে তার একখানা দোকান। ছোটকালে পয়সার অভাবে ইংরেজি স্কুলে তার পড়া হয় নাই, যদিও জ্ঞানলাভের প্রতি তার বিপুল আগ্রহ ছিল। সেই যে বাল্যে ওস্তাদ সাহেবের পাঠশালায় সে প্রাইমারি পাশ করিয়াছিল, তারপর আর তার কোনো স্কুলে পড়া হয় নাই।
অনেক বৎসর পড়া ছাড়িয়া দিলেও, সে নজরের সম্মুখে যে বাঙালা বইখানা পাইত তাহাই আগ্রহের সঙ্গে পাঠ করিত। আত্মার সন্দেহ দিকটা চাপা পড়ে যাওয়াতে রায়হানের ব্যবহার, কথা ও স্বভাব দিন দিন অধিকতর মার্জিত হইয়া প্রকাশ পাইতেছিল। গ্রামে রাস্তার পার্শ্বে তাহার একখানা দোকান ছিল।
দোকানে চাল, ডাল, চিড়ে, মুড়ি, গুড়, সরিষার তৈল, আরও অনেক রকম জিনিস পাওয়া যাইত। ক্রেতাদের সঙ্গে তার ব্যবহার খুবই মধুর। তার অভ্যাস–একবার ছাড়া দুইবার কোনো জিনিসের দাম না বলা। সে কাহাকেও কোনো জিনিস বাকি দেয় না। প্রথমে ইহার জন্য অনেকে তার উপর অসন্তুষ্ট হইয়াছিল। কিন্তু সে কাহারও কথা শুনে নাই। এমন কি, গ্রামের অনেক ভদ্রলোক প্রথম প্রথম তার দোকান জোর করিয়া তুলিয়া দিবেন বলিয়াছিলেন, কিন্তু ভাগ্যে গ্রামের নসির মিঞা তার দিকে ছিলেন। নসির মিঞা মসজিদের ভিতর বলিয়া দিয়াছিলেন, গ্রামে দোকান থাকাতে সকলের পক্ষেই লাভ। বাকি লইলে দোকান থাকিবে না। নসির মিঞা গ্রামের মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী লোক, অথচ অত্যাচারী নন।
কেউ কেউ সন্দেহ করিয়াছিল যে, সকলের সুবিধা নষ্ট করিয়া নসির নিজের সুবিধা করিয়া লইলেন। কিন্তু তিনি সে ধরনের লোক নন। তার ছেলে একদিন দোকানে বাকি জিনিস আনিতে গিয়াছিল–শুনিতে পাইয়া তিনি ছেলেকে মারিয়াছিলেন এবং ভর্ৎসনা করিয়াছিলেন। ক্রমশ রায়হানের অনেক মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী বন্ধু জুটে গেল। আবদুল হামিদ তাদের একজন। ইদানীং কেউ কোনো জিনিস তার দোকান হইতে ধারে লইত না। সকলেই বুঝিয়াছিল ধার করিয়া জিনিস লইলে সেই ছোট দোকানের ছোট প্রাণটি দুই দিনেই বাহির হইয়া যাইবে।
সন্ধ্যাবেলা রাজভাষাখানা একটু পড়িয়া দোকানের দুয়ার বন্ধ করিয়া রায়হান ভাত খাইতে বাড়ি যাইতেছিল। আবদুল হামিদের বাহির-বাড়ির উপর দিয়াই তাহার পথ।
জোছনার আলোকের মধ্যে দাঁড়াইয়া হামিদের বিধবা বোন করিমা একটু বড় পেয়ারা গাছের মাথার দিকে চাহিয়াছিলেন। করিমার বয়স পঁচিশ। বর্ণ উজ্জ্বল গৌর, বৈধব্যের অবহেলায় কিঞ্চিৎ স্লান ও নিষ্প্রভ, তবুও কোনো অপরিচিত মানুষ সে মুখের দিকে যদি চাহিত, সে স্তব্ধ হইয়া যাইত।
রায়হান করিমাকে একাকী বাহির-বাড়ির প্রাঙ্গণে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া মাথা নত করিয়া চলিয়া যাইতেছিল। করিমা ডাকিয়া কহিলেন,–রায়হান, তুমি বড় লাজুক এবং তার ফলে অভদ্র।”
রায়হান বলিলেন–“আপনি আমার বাল্যবন্ধু হলেও বয়সকে মেনে চলতে হবে।”
“ছিঃ! এরূপ কথা বলা অন্যায়। এস আমাদের বাড়ির ভিতর।” রায়হান করিমার সহিত বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিল।
হামিদ তখন পড়িতেছিল। রায়হানকে দেখিয়া সে কহিল, “রায়হান, আমার বাংলা পড়াটা বুঝিয়ে দিয়ে যাও তো।”
করিমার মা হাফিজা সেখানে ছিলেন। পুত্রের ধৃষ্টতার বিরক্ত হইয়া তিনি কহিলেন, “হামিদ, কথা বলতে জান না।” হামিদ অপ্রস্তুত হইয়া চুপ করিয়া রহিল।
মৌলবী সাজেদ আলী রিটায়াড় পুলিশ ইন্সপেক্টর। শেষ বয়সের পুত্র হামিদ আহ্লাদে একটু বেয়াদব হইয়া পড়িয়াছিল।
হাফিজা রায়হানকে বসিতে বলিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন,–“দোকান কেমন চলছে বাবা?”
রায়হান সে কথার উত্তর না দিয়া কহিল–চাচি, হামিদ আমার এক বয়সের, অমন করে কথা বল্লেও বিশেষ দোষ হবে না।”
হাফিজা বলিলেন–“তুমি হচ্ছ করিমার বয়সের, যদি ও ওর বুয়াকে মানে তাহলে তোমাকেও মানতে হবে। সম্রম করে কথা না বলুক বাড়ির উপর মানুষ এলে বসতেও কি বলতে নেই? সোজাসুজি নাম ধরে নবাবের মতো হুকুম!”
হামিদকে একটু উৎসাহিত করিয়া তুলিবার জন্য রায়হান স্বইচ্ছায় তাহাকে খানিক বাংলা পড়াইয়া দিলেন। ঘরে পড়িয়া রায়হানের বাংলা ভাষার জ্ঞান জন্মিয়াছিল, সুতরাং অনায়াসে দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র হামিদকে পড়াইতে সক্ষম হইলেন।
হাফিজা মেয়েকে বলিলেন–“রায়হানকে কিছু খেতে দাও।” তারপর একটু থামিয়া কহিলেন–“রায়হান, ছোটকালে তুমি এখানেই সারাদিন করিমার সঙ্গে খেলে খেলে কাটিয়ে দিতে।”