“বঙ্গের নারীর অপরিসীম দুঃখের একমাত্র কারণ অবরোধ প্রথা (পর্দা নহে)। মূর্খতা ও মিথ্যা লজ্জার প্রশংসা। নারী কাঁদিলেও তাহার রূপ ফুটিয়া উঠে–অশ্রুবিন্দুগুলি মুক্তাবিন্দু বলিয়া অনুমিত হয়–এ কথা, এ ভালবাসা আর আমরা শুনিতে চাই না। পেটে আমাদের অন্ন নাই-পরণে বসন নাই–আত্মায় শুভদ্রতা। নাই–চক্ষু আমাদের শরমে মুদ্রিত-নারী নিরাপদ ওয়েটিং রুমে দাঁড়াইয়া বা অন্ধকারে ছুরি দিয়া সতীত্ব রক্ষা করিবে না–সে পুরুষের মতো আলোকে দাঁড়াইয়া সকলের সম্মুখে নীরব ভাষায় বলিবে–আমাদের ব্যক্তিত্বের মর্যাদা আছে। আমরা এত নির্ভরশীল হইতে পারি না। আমরা মাথা হাত ও পায়ের সম্পূর্ণ ব্যবহার চাই।”
“অত্যধিক শরমের প্রশংসায় আমরা মনুষ্যহীন হইয়া পড়িয়াছি। দারুণ বিপদে পড়িয়াও আমরা চিৎকার করিয়া জোর করিয়া দেশের মানুষকে বলিতে পারি না আমাদিগকে রক্ষা কর। দেশে বহু মেয়েচুরির কথা শুনিতে পাই, কিন্তু কই, পুরুষ-ছেলেকে তো কেউ চুরি করিতে সাহস পায় না? ভিতরে যদি তাহাদের শিক্ষার শক্তি থাকিত তাহা হইলে কি তাহাদিগকে প্রাণহীন বস্তুর মতো লুকাইয়া রাখিতে সাহস পাইত? পুরুষের মতো সে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করিতে পারিত। পুরুষ হাজার বার পাপ করিলেও তাহার দোষ হয় না, নারী একবার পাপ করিলে সে ঘৃণিত, লাঞ্ছিত ও সংসার হইতে তাড়িত হয় কেন? সে কি অনুতাপ করিতে জানে না?”
“যে হৃদয় জ্ঞানের আলোক পায় নাই–যেমন সদা নির্ভরশীল, পরমুখাপেক্ষী ও শক্তিহীন সে হৃদয়ই নহে। ইসলাম ক্রীতদাসকে স্বাধীন করিয়া দিয়া পূণ্য অর্জন করে, আর ইসলাম কি নারীকে অন্ধ, শক্তিহীন এবং ক্রীতদাসীর জীবন গ্রহণ করিতে অনুমোদন করিতে পারে?”
একজন জিজ্ঞাসা করিলেন–“নারীদের জন্য যে বিদ্যালয় খোলা হইবে তাহাতে কী কী বিষয় শিক্ষা দেওয়া হইবে?
রায়হান বলিলেন–“শ্রদ্ধেয়া করিমা বিবি মেয়েদের এবং মহিলাদের নৈতিক ও মানসিক উন্নতির জন্য পরিশ্রম করিবেন। শিল্প-শিক্ষয়িত্রী যত দিন না পাওয়া যায় ততদিন আমি নিজে ছাত্রীদিকে সেলাইয়ের কাজ শিক্ষা দিব। আমার দুইশত টাকা মূল্যের দুইটি মেশিন পূর্বেই এই বিদ্যালয়ের জন্য দান করিয়াছি। যত শীঘ্র সম্ভব পুস্তক বাঁধাই শিক্ষা। এবং মিস্ত্রীর কাজ মহিলাদিগকে শিক্ষা দিতে চাই।”
অতঃপর আরও কয়েকজন ভদ্রলোক অনুষ্ঠানকে প্রশংসা করিয়া বক্তৃতা প্রদান করিলেন। শ্রোতামণ্ডলীর চাহনি ও ভাবে ক্রমশ অধিকতর সহানুভূতির চিহ্ন দেখা যাইতে লাগিল।
একজন দাঁড়াইয়া বলিলেন–“মহিলা কেন, ছেলেদের জন্যও শিল্প-বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়া আবশ্যক।”
রায়হান বলিলেন–“ছেলে বিদ্যা লাভ করিয়া শক্তিমান পুরুষ হইবার যথেষ্ট সুযোগ পায়। সে অরণ্যে প্রবেশ করিয়া শার্দুলকে সমরে আহ্বান করে। নারী দুর্বলতাহাকেই অধিক সুযোগ দেওয়া কর্তব্য।”
সর্বশেষে করিমা বিবির পিতা সভাপতি রূপে কহিলেন–“উপস্থিত ভদ্রমণ্ডলী এবং স্নেহের পুত্র-কন্যাগণ! আজ আমি কী বলব, বুঝিতেছি না। আনন্দে চিত্ত ভরিয়া উঠিয়াছে। যাহা ভাবিতে পারি নাই তাহা আজ প্রত্যক্ষ করিলাম। নবীন পুত্র-কন্যাদের ভিতর মানুষের জন্য যে এমন বেদনা বোধ জন্মিয়াছে ইহা ভাবিয়া আমি পুলকিত হইতেছি। দুঃস্থ সহায়শূন্য রমণীদের জীবন দেখিয়া সত্যসত্যই মনে হয় ইহারা সংসারের আবর্জনা বিশেষ। হস্ত পদ থাকা সত্ত্বেও কে ইহাদিগকে নিজীব জড়পদার্থ করিয়া তুলিয়াচে তাহা বুঝিতে। পারিতেছি না। প্রিয়তম কল্যাণীয় রায়হান মিঞা এবং আমার কন্যা কল্যাণীয়া করিমা ও অন্যান্য বক্তারা যাহা বলিয়াছেন তাহাই আমাকে পুনরায় বলিতে হইবে।”
“আমি জানি, এক ভদ্রলোক একদা মক্কাশরীফ অভিমুখে যাত্রা করিলেন। তাঁহার উদ্দেশ্য ছিল পূণ্য লাভ করা। তিনি যে দিন উৎসব করিয়া যাত্রা করিলেন ঠিক সেই দিন তাহারি গৃহপার্শ্বে এক বৃদ্ধা অনশনে কাল কাটাতেছিল।”
“দেশের রমণীদের জীবন ভারস্বরূপ এ-কথা খুবই সত্য। কন্যা বলিয়া বাল্যকালে তাহাকে এক পার্শ্বে বসিতে হয়, অল্প খাইতে হয়–জগতের সকল সৌন্দর্য ও জ্ঞান তাহার দৃষ্টির সম্মুখ হইতে সরাইয়া লওয়া হয়। বিবাহের পর অনুন্নত আত্মা লইয়া স্বামীগৃহ হইতে তাহাকে পদে পদে লাঞ্ছিত হইতে হয়। যদি কোনো কারণে সে স্বামীগৃহ হইতে ফিরিয়া আসে তাহা হইলে জীবন অন্ধকারময়। মনে হয়, খুবই ভয়ানক।”
“আর এ কথা–বহু বালিকা দুষ্ট লোকের ষড়যন্ত্রে পতিতাদের হস্তে পড়ে। আহা! অনিচ্ছা সত্ত্বেও কত কুসুম-কলিকা বালিকা পাপের পথে পড়িয়া আছে, কে তার খবর রাখে? এইসব বালিকার ফিরিবার পথ নাই। সমস্ত বিশ্ব তাহাদিগকে দূর করিয়া দেয়–অপমান ও লজ্জা ছাড়া তাহাদের ভাগ্যে আর কিছু থাকে না। এই সব বালিকার বাহুতে যদি শক্তি থাকিত–যদি তাহাদের পুরুষের ন্যায় নিজদিগকে প্রতিষ্ঠিত করিবার ক্ষমতা থাকিত, তাহা হইলে তাহারা সেই সব পৈশাচিক স্থানে বাস করিতে বাধ্য হইত না। স্ত্রীলোকে অনেক সময় স্বামীর গৃহের তাচ্ছিল্য ও লাঞ্ছনার ভয়ানক পরিণামের কথা বলিয়া থাকে। তার কারণ স্ত্রীলোকদের সত্যসত্যই রূপ ছাড়া গর্ব করিবার আর কিছু নাই। একেবারেই তাহার আবর্জনা বিশেষ-পরমুখাপেক্ষী, অত্যন্ত নির্ভরশীল। কে কবে দীনহীন দরিদ্রকে ভালবাসে? কুরূপা নারীও সম্পদশালিনী হইলে তাহাকে সকলেই ভালবাসে।”