করিমার উপর রায়হানের শ্রদ্ধাভাব জন্মিয়া গেল। করিমা যে সাধারণ নারী নহে, ইহাও তিনি বুঝিলেন। তাহার বিশ্বাস হইল, করিমা ও তিনি একসঙ্গে কাজ করিলে সমবেত চেষ্টায় নারীর মঙ্গল করিতে তাহার খুবই সুবিধা হইবে।
সভা বসিবার পূর্বে রায়হান গ্রামস্থ মুরব্বীদের সঙ্গে দেখা করিয়া তাঁহার ও করিমার অভিপ্রায় জ্ঞাপন করিয়া সহানুভূতি লাভ করিয়াছিলেন।
অদ্য গ্রাম্যসভায় এই বিষয়ের আলোচনা হইবার কথা।
নারী এবং পুরুষদের জন্য উভয় প্রকোষ্ঠেই ঢালা ফরাস পাতা হইয়াছিল। যথাসময়ে সভার কার্য আরম্ভ হইল।
সভাপতি হইলেন হামিদের পিতা সভাপতির আজ্ঞায় রায়হান কহিলেন, “উপস্থিত। মহিলাবৃন্দ এবং দ্ৰ মহোদয়গণ! অদ্যকার সভার উদ্দেশ্য কি তাহা আপনারা অনেকেই জানেন। তথাচ সর্বসাধারণের সুবিধা ও মত জানিবার জন্য আমি কিছু বলিতে চাই। আমাদের দেশের হিন্দু এবং মুসলমান রমণীদের দুর্গতি ভাষায় প্রকাশ করা সুকঠিন।”
“জ্ঞানের দিক দিয়ে যেমন ইহারা দরিদ্র, তেমনি মর্যাদায়ও ইহারা দরিদ্র। অন্ধতা, মূর্খতা, সহায়শূন্যতা ও দারিদ্র্য আমাদের নারীজাতিকে পশু করিয়াছে। নারীর কোনো শিক্ষার আবশ্যকতা নাই–এ কথা যিনি বলেন তাহাকে কয়েকদিন তাহা অপেক্ষা একজন হী প্রকৃতির মানুষের সঙ্গে বাস করিতে অনুরোধ করি। তিনি বুঝিতে পারিবেন তাহার জীবনে কতখানি অশান্তি উপস্থিত হইয়াছে। নারী নারী বলিয়াই সে আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা পাইবে ইহা যেন কেহ মনে না করেন। নারী যে মানুষ-মানুষ রূপেই সে অধিক। করিয়া আমাদের প্রেম লাভ করিবে। তাহার মনুষ্যত্ব তাহার নারীত্বকে সমুজ্জ্বল করিয়া তুলিবে। মনুষ্যত্ব দূরে ফেলিয়া শুধু নারীত্ব আমাদের মন আকৃষ্ট যেন না করে।
“অশিক্ষিতা নারীর দ্বারা জীবন কোনোকালে সরস হয় না এবং পদে পদে বিড়ম্বনা ভোগ করিতে হয়, সে যত বড় সুন্দরী সম্পদশালিনী হউক না কেন, নারীর কাছে কি আত্মা নাই? নারী হইয়া জন্মিয়াছে বলিয়াই কি বিধাতার শ্রেষ্ঠ দান-জ্ঞান বঞ্চিত থাকিয়া মনুষ্যত্ব ও ইসলামকে অস্বীকার করিবে? আহা, যাহার মধ্যে জ্ঞান নাই সে যে বড় দীন। যাহার অর্থ নাই সে দরিদ্র নহে–যে জ্ঞানান্ধ তাহার কাছে সহস্র প্রাণহীন স্বর্ণমুদ্রা থাকিলেও সে বড় দরিদ্র, এ কথা আমরা কবে বুঝিব? দেশবিখ্যাত জননায়কের ভগ্নি হইয়া জন্মিয়াছিলেন। বলিয়াই কি তিনি চিরদুঃখিনী-অন্ধ, পরমুখাপেক্ষী ও মর্যাদাশূন্য হইয়া থাকিবেন? এটা অন্যায় ও অত্যাচার। মমতাই রূপ, নারী মমতাহীন, অন্ধ ও দুর্বল,তাহার রূপের কোনো মূল্য নাই। সে সাময়িক বিলাসের পাত্র–তাহাকে শক্তি দেওয়া হউক, তাহাকে রূপময়ী করিয়া তোলা হউক।”
“যে স্বামী বা পিতা স্ত্রীকে বা কন্যাকে অলঙ্কার বা অর্থ দান করিলেন, তিনি কিছুই দিলেন না। স্বামী যদি স্ত্রীকে অলঙ্কারের পরিবর্তে জ্ঞান দান করিতেন তাবে তাহার মূল্য অধিক হইত। জীবনের এত আপনার জন, যাহাকে নয়নে নয়নে রাখতে চাই, সর্বদা যাহার। মঙ্গল কামনা করি, সেই চারু সঙ্গিনীকে সকল দান অপেক্ষা মহৎ দান হইতে দূরে রাখলাম। বন্ধুর পক্ষে ইহা অপেক্ষা নিষ্ঠুরতা আর নাই। প্রিয়তমার জড়দেহ লইয়া টানাটানি করিলাম, কিন্তু তাহার আত্মা আমারই সম্মুখে দুর্গন্ধ কীটময় রহিয়া গেল, তাহা আমি দেখিলাম না। কেননা, আমি তাহাকে ভালবাসি!–আত্মা তাহার আমার সম্মুখে রুধিরাপুত হইল, আমার চক্ষু দিয়া এক ফোঁটা জলও বাহির হইল না। এই মানবজন্ম আর কি আসিবে?”
“যে সব নারী বিধবা হইয়া অপরের গলগ্রহ তাহাদের কষ্টের সীমা থাকে না। নারী যদি হস্তপদের পূর্ণ ব্যবহার শিখে তাহা হইলে তাহাকে আর এত পরমুখাপেক্ষী হইতে হয় না। দেশের, সমাজের, এমন কি স্বামীর কাছে সে সম্মান লাভ করে। নারীকে শিক্ষা দিতে হইবে। তাহাকে স্বাধীনভাবে জীবিকার্জনের পথ দেখাইতে হইবে। দেশের অনেক নারী দুঃখে, দারিদ্র্যে ও বিপদে পড়িয়া পাপ পথে বাহির হয়। তাহাদের অন্ন যদি থাকিত, যদি দুষ্ট শয়তানদের ছলনা বুঝিবার মতো জ্ঞান তাহাদের থাকিত, তাহা হইলে তাহারা পাপের পথে যাইত না। নারী একবার পাপ করিলে তাহাকে সংসার ও সমাজ হইতে বাহির করিয়া দেওয়া হয়। এইসব সমাজতাড়িতা নারী অন্নসংস্থানের পথ না পাইয়া, হৃদয়ের দীনতা লইয়া নিজকে প্রতিষ্ঠিত করিতে পারে না। পুরুষের মতো হারান সম্মান ফিরাইয়া আনিবার শক্তি তাহাদের নাই। ফলে তাহারা লম্পট মানুষের বিলাসপুত্তলি হয়। না হইয়াও তাহারা পারে না। এইসব নারীদের যদি কোনো দাঁড়াইবার স্থান থাকিত, তাহা হইলে তাহারা নিজের ও বাংলার বুকে এত আগুন জ্বালাইত না।”
“অসহায় ও নিরাশ্রয় নারীদের জন্য আমরা আমাদের গ্রামে একটি বিদ্যালয় খুলিতে চাহিতেছি। এই কার্যের প্রতি সকলেরই সহানুভূতি আকর্ষিত হইয়াছে–ইহা সুখের কথা।”
অতঃপর পরদার অন্য ধার হইতে করিমা কহিলেন ”সভাপতি এবং উপস্থিত ভদ্রমণ্ডলী! নারীদের দুঃখে যে আপনারা বিচলিত হইয়াছেন ইহা খুবই আশা কথা। গত কয় বৎসর ধরিয়া নারীদের অবস্থার কথা যতই চিন্তা করিয়াছি ততই ব্যথায় অবনত হইয়া পড়িয়াছি। নারী আর সুনামের মহিমায় বাঁচিতে পারিতেছে না। মনে হও তাহাকে অবাধ্য ও বিদ্রোহী হইতে হইবে। সে কাহারও নিকট দয়া পাইতে চায় না। লজ্জহীনার মতো হয়তো তাহাকে ন্যায্য দাবি বুঝিয়া লাইতে হইবে।”