বিনোদিনী খোরশেদকে বসিতে দিয়া, তাহার গায়ে বাতাস করিতে লাগিলেন। খোরশেদ মনে মনে হাসিল।
শ্যামসুন্দর কহিল—”বোনের বিয়ে তো হয়ে গেল। বেশ ভালো ঘরই বটে। সে দেশে ভদ্রলোক বেশি না মোসলমানই বেশি?”
খোরশেদ সহজভাবে উত্তর করিল–“মুসলমান ভদ্রলোকই বেশি।”
বিনোদিনী কহিলেন–“তুমি কবে যাবে বাবা?”
খোরশেদ–এই দুই চার দিনেই যাব। প্রথমে রাচির ট্রেনিং-এ কিছুদিন থাকতে হবে; তারপর কোনো জায়গায় স্থায়ী হবে।
বিনোদিনী–এখন কত করে পাবে?
খোরশেদ–যত দিন ট্রেনিং-এ থাকবে ততদিন বেতন ৫০ টাকা, তারপর থানায় স্থায়ী হলে বেশি।
বিনোদিনী–আর জন্মে তুমি আমার ছেলে ছিলে। তোমাকে দেখতে ঠিক হিন্দুর মতো।
এমন সময় গিরি বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিল। মুখে তার হাসি-চোখে একটা স্নিগ্ধ সন্তোষ। অঞ্চল তাহার খোরশেদের গায়ে লাগিয়া গেল।
খোরশেদ কথা বলিল না।
শ্যামসুন্দর কী কাজে বাহিরে গেলেন। মাতা তনয়াকে বলিলেন–“গিরি! তোমার দাদাকে কিছু জলখাবার দাও।”
খোরশেদ আপত্তি জানইলেও গিরি তাহার হাত ধরিয়া ঘরের মধ্যে লইয়া গেল।
উঠানে এমন সময় একটি মুসলমান ভিখারিনী আসিয়া আল্লা ও মোহাম্মাদের নাম করিয়া ভিক্ষা চাহিলে, কিন্তু তাহার কাথায় কেহ উত্তর দিল না।
নানাবিধ মিষ্টান্ন দিয়া গিরি অনুরোধ করিয়া খোরশেদকে আপ্যায়িত করিল।
জল লইতে বাহিরে আসিয়া গিরি দেখিল ভিখারিনী রান্নাঘরের ডোয়ার উপর ভর দিয়া দাঁড়াইয়া আছে।
গিরির মা চিৎকার করিয়া বলিলেন–“ওমা, মুসলমান ঘর ছুঁয়ে হাঁড়ি বাসন নষ্ট করলে গো! আজ আর খাওয়া হবে না গিরি, মাগীর চুল চেপে ধর। যা, যা, মুসলমানের হাই দেখ।”
ভিখারিনী অপ্রস্তুত হইয়া বাহির হইয়া গেল। গিরি খোরশেদকে ডাকিয়া কহিল–“খোরশেদ, দেখ তো দাদা, ছোট লোকের হাই!”
তখন সন্ধ্যা। খোরশেদ কথা না বলিয়া গিরি ও বিনোদিনীর কাছে বিদায় প্রার্থনা করিল।
গিরি অবাক হইয়া বলিল–“না দাদা, আজ তুমি যেতে পারবে না, আজ থাক, কাল যাবে।”
বিনোদিনী কহিলেন–“ওমা–সেকি কথা! এই এলে, আবার এখনই যাবে? তুমি কি আমাদের পর?
শ্যামসুন্দর বাহির-বাড়ি হইতে গাভীর দড়ি ধরিয়া ভিতরে প্রবেশ করিলেন। তিনিও বিস্মিত হইয়া বলিলেন–“না, না, আজ থাক্। পরের বাড়ি তো নয়।”
অগত্যা চাকরটি বাড়ি ফিরিয়া গেল। খোরশেদের যাওয়া হইল না।
কথায় কথায় রাত্রি তখন এগারটা হইয়া গিয়াছিল।
শ্যামলাল ঘোষপাড়ায় শালিসীতে গিয়াছিলেন। কখন ফিরিয়া আসিবেন ঠিক ছিল না।
গ্রীষ্মতিশয্যে খোরশেদ অনেকক্ষণ ধরিয়া বাহিরে গাছ তলায় বাসিয়াছিল। মুক্তমাঠ হইতে শীতল বাতাস ধীরগতিতে প্রবাহিত হইতেছিল। চন্দ্রালোকে রজনী হাস্যময়ী। জোছনা-বাতাসে বেদনাবিধুর প্রণয় তরল তরঙ্গাকারে উচ্ছলিত। প্রাণময় প্রকৃতির কণ্ঠ হইতে যেন সঙ্গীতধ্বনি শোনা যাইতেছিল।
পেছন হইতে খোরশেদকে চমকিত করিয়া গিরি কহিল–“কী ভাবছ?”
অতঃপর সে খোরশেদের পার্শ্বে বসিয়া পড়িল। গিরির উজ্জ্বল ললাটে শুভ্র জোছনা সুষমা রচনা করিতেছিল। কী কমনীয় মাধুরীমাখা মুখখানি!
খোরশেদ স্তব্ধ বিস্ময়ে গিরির মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
গিরি শান্ত নম্র স্বরে কহিল–“এই মোহিনী প্রকৃতির অনন্ত পুলকের মধ্যে ইচ্ছা হয় বাতাসের উপর খেলিয়া বেড়াই। আর সঙ্গে থাকে আর একজন।”
খোরশেদ–“কে সে?”
“যাকে ভালবাসা যায় সেই প্রাণের দোসর।”
“ঠিক বলেছ। আমিও তাই ভাবছিলাম।”
“বন্ধু ও সাথী বিহনে জীবন বৃথা। এই মাধুরী-মহিমা, এই আলোক বাতাস সবই প্রাণহীন পাথরের স্তূপ।”
“ঠিক গিরি! জীবন আমার দুঃখময়। এ দুঃখের অবসান হবে না।”
“নিশ্চয়ই হবে। দেবতার দয়া হলে তোমার দুঃখের পথে সুখের ফুল ফুটবে।”
“তুমি যা বলছো গিরি, ঠিক বলছো?”
“হ্যাঁ ঠিক বলছি।”
“ছাই, প্রাণের আবেগে কী সব কথা বলে ফেলেছি! তুমি যে আমার দিদি।”
“ছিঃ ও কথা বলো না।”
তাহার পর তাহারা মৌন হইয়া আকাশের দিকে চাহিয়া রহিল। প্রায় এক ঘণ্টা অন্তর মৌনতা ভাঙ্গিয়া জড়িত কণ্ঠ গিরি কহিল–“খোরশেদ, তুমি আমাকে ভালবাস?”
খোরশেদ সহজ স্বরে উত্তর করিল–“হ্যাঁ ভালবাসি।” গিরির সারা অঙ্গ স্পন্দিত হইয়া উঠিল। চক্ষু তাহার মুদ্রিত হইয়া আসিতেছিল।
সে সহসা মূৰ্ছিত হইয়া মাটিতে পড়িয়া গেল।
.
চতুর্দশ পরিচ্ছেদ
দুইটি বড় বড় রাস্তা আড়াআড়িভাবে গ্রামখানিকে মাঝখান দিয়া বিভক্ত করিয়া দিয়াছে। গ্রামের ভদ্র শ্রেণীর ইচ্ছা ও উৎসাহেই রাস্তা প্রস্তুত হইয়াছিল। কৃষক ও ভদ্র সকলে মিলিয়া স্বহস্তে গ্রামবাসীদের সুবিধার জন্য সড়কদ্বয় প্রস্তুত করিয়াছিলেন। গ্রামকে প্রদক্ষিণ করিবারও একটা সড়ক ছিল।
দুইটি রাস্তার সঙ্গমস্থলে গ্রাম্য সভাগৃহ। ছোট একখানা চার-চালা ঘর। মাঝখানে পার্টিশন দেওয়া। আগে এই পার্টিশন ছিল না। স্ত্রীলোকেরাও যাহাতে পর্দা রক্ষা করিয়া গ্রাম্য সভায় যোগদান করিতে পারেন–এই উদ্দেশ্যে কয়েক মাস হইতে পার্টিশন বসান হইয়াছে।
করিমা তাঁহার চিন্তার কথা রায়হানকে বলিয়াছিলেন–নারীকে যদি শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে শিল্প শিখান যায় তাহা হইলে তাহার এত দরবস্থা থাকে না।
রায়হানও বহুদিন হইতে নারীর দৈন্য-দুর্দশার কথা ভাবিয়া আসিতে ছিলেন। করিমার নারী হৃদয়ে তাহার নিজের চিন্তার ধ্বনি পাইয়া তিনি খুবই উৎসাহিত হইয়া উঠিলেন এবং ইচ্ছা করিলেন গ্রামস্থ ভ্রমণ্ডলীর সাহায্য লইয়া তিনি এক নারী-শিল্প-বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করিবেন। সেখানে সর্বশ্রেণীর নারী শিল্প শিক্ষা করিতে পারিবে।