একটু নিস্তব্ধ থাকিয়া শাহাদত পুনরায় বলিল–“বি. এ. পাশ করে যা না হতো এই বিয়ের দ্বারা তোমার তা হবে। সম্মানের চূড়ান্ত। কপাল তোমার। বাবা, তোমার বিয়ের ঘটকালিও আমি করবো।”
খানা তখন প্রস্তুত হইয়াছিল। নজির মিঞা বাহিরে আসিয়া বৈঠকখানায় দস্তরখানা পাতিবার জন্য ভূত্যকে আদেশ দিলেন। খাঞ্চায় খাঞ্চায় আহার সামগ্রী আসিল।
শাহাদাত খোরশেদ যথেষ্ট আদব-কায়দার সহিত জানু ভাঙ্গিয়া উপবেশন করিলেন। ব্যঞ্জনের বহর দেখিয়া খোরশেদ শাহাদত মিঞার গা টিপিয়া কহিল–“একেবারে শরীফ!
নজির হাসিয়া কহিলেন–“শাহাদম মিঞা, সামান্য কিছু প্রস্তুত হয়েছে।” খোরশেদের দিকে চাচিয়া বলিলেন ”বাবা খোশেদ, আপনারা তো বড়লোক। গরিব মানুষের বাড়ির সামান্য নুন-ভাত খেয়ে দেশে যেয়ে বদনাম করবেন না। কাজ যদি হয় তবে গরিবের বাড়ি আপনাদের মতো লোকের পায়ের ধুলো পড়বে। নয় তো এই শেষ।”
খোরশেদ আপনার অনুগ্রহ হলেই হতে পারে।
নজির–আমার এনায়েত যেমন ছেলে তেমন ছেলে এদেশে নেই। কী করি–খরচ পত্র আর কুলিয়ে ওঠে না। বাবার জন্য এ পর্যন্ত আমার পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে। বইয়ের খরচ লেগেছে এবার দুশো টাকা।
শাহাদত বলিলেন–তা তো লাগবেই–তিনি বুঝি ফাস্ট ক্লাশ পড়ছেন?
নজির–হ্যাঁ ভাই ফাস্ট ক্লাশে পড়ছে। বড় তেজী ছেলে। সেদিন তর্ক করে সে স্কুলের হেডমাস্টারকে হারিয়ে দিয়েছিল। এ-দেশের কোনো মাস্টার আর তাকে পড়াতে পারবে বলে মনে হয় না। তাকে কলকাতায় পাঠাতে চাই। কিন্তু একা তো আর খরচ চালাতে পারি নে।
শাহাদাত–আপনি খুব ভালো মতলব এটেছেন। পাড়া গাঁয়ে থাকলে ছেলেপিলে বোকা হয়। কোথায় কলকাতার শহর আর কোথায় পল্লীর মহাকুমার স্কুল। রাজধানীর ছেলেপিলের মনে জোর কত! সেখানে পড়াশুনাই বা হয় কত চমৎকার! মুখে তাদের রাতদিন ইংরেজি লেগেই আছে। তাদের খরচ-পত্র সম্বন্ধে কী ভাবনা? আল্লার রহমে একরকম হয়েই যাবে। কোনো দিন কাজ কি বেঁধে থাকে?
নাজির–আর এক কথা–দেশীয় স্কুলের মাস্টার বেটারা একেবারে জোচ্চোর। ইচ্ছে। করে ছেলেদিগকে ফেল করে দেয়। পাশ যেন তাদের বাবার ঘরের তালুক। উপর ক্লাশে তুলে দিতে যেন ব্যাটাদের পুত্রশোক হয়। খোশা-মোদ না করলে আর কারো পাশ হবার
যো নেই। এনায়েত এমন তেজী ছেলে তবুও বছর বছর তাকে তুলে দেবার জন্য মাস্টারদের খোশামদ করতে হয়েছিল।
খোরশেদভাই সাহেব কত নম্বর পেয়েছিলেন? নজির–ছেলে খুব ভালোই লিখেছিল। ঐ যে বল্লাম, ভালো লিখলে কী হবে?
রাত্রি হইয়া গিয়াছে দেখিয়া সকলে আহারাদি শেষ করিলেন। আহার করাইলেন এনায়েত আলী।
অতঃপর বিবাহের কথা আরম্ভ হইল। নজির মিঞা কহিলেন–“লেখাপড়া জানা। মেয়েরা বড় বেহায়া। আশাকরি, আমার ভাবী পুত্র বধূ এই পড়ার ধার ধারেন না।”
খোরশেদ–“কিছু না, আমার ভগ্নি একেবারে বোকা। দুই পয়সা আর দুই পয়সা কত হয় তা সে জানে না।“
অতঃপর শাহাদাত মিঞা কহিলেন–“বন্ধু! আপনার কাছে কি কোনো কথা ভাড়িয়ে বলা যায়। মেয়ে সম্বন্ধে যা বলেছি তার একবর্ণও মিথ্যা নয়। ভদ্ৰপরিবারে কি লেখাপড়ার চর্চা করে মেয়েদিগকে ব্রাহ্ম-খ্রিস্টান করে তোলা হবে? ছিঃ ছিঃ, তাতে কি ভালো মানুষের ইজ্জত থাকে?”
অতপর বহু কথার পর ঠিক হইল ছেলেকে মাসে-মাসে কন্যাপক্ষকে, বেশি নয়, ১০ টাকা করিয়া পড়ার খরচ দিতে হইবে। গহনা খোরশেদকেই দিতে হইবে। রূপার গনহার আবশ্যকতা নাই–সব কয়খানিই সোনার হইবে।
খোরশেদ তাহাতেই স্বীকৃত হইল। আরও কথা হইল নজির মিঞা, বেশি নয়–২শত বরযাত্রী লইয়া যাইবেন। বাছা বাছা কুটুম্বকে উপঢৌকন ও রেল ভাড়া খোরশেদ দিবে।
বিবাহ সম্বন্ধে আরও আবশ্যক-অনাবশ্যক বহু কথা হইল। সর্বশেষ খোরশেদ গল্পচ্ছলে কহিল–তাহাদের মতো জমিদার তাহাদের দেশে আর কেই নাই। তাহাদের বাড়িতে যে দশজন চাকরানী খাটে, তাহাদের পরনে হামেশা কাজ করবার বেলায়ও দশ বিশ টাকা দামের শাড়ি থাকে।
নজির মিয়া মনে মনে আনন্দ লাভ করিলেন। ভাবিলেন যা-হোক, এতদিন পর একঘর কুটুম্ব পাওয়া গেল। –প্রত্যাবর্তনকালে খোরশেদ কলিকাতা হইতে কতকগুলি চীনা বাসন ও গিল্টি করা গহনা ক্রয় করিয়া আনিল। ভদ্রলোকের বাড়িতে চীনামাটিও কাঁচের বাসন থাকা দরকার, খোরশেদের ধারণা ছিল এই রকম। বিবাহের দিন বরযাত্রীরা সাদা কাঁচের পাত্রগুলি দেখিয়াই খোরশেদের শরীফত্ব সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হইবে আর কি!
.
এয়োদশ পরিচ্ছেদ
প্রখর সূর্যত্তাপে ধরণী উষ্ণশ্বাস ফেলিতেছিল।
খোরশেদ কয়েকটা ডাব এবং এক বদনা দুধ লইয়া শ্যামসুন্দরের বাড়িতে যাইয়া উপস্থিত হইল। রূপ ও গৌরবে গিরি পথেই দাঁড়াইয়াছিল। সে জল আনিতে যাইতে ছিল। হাতে তাহার স্বর্ণবলয়, বাহুতে অনন্ত, কপালে টিপ।
বাতাস তাহার অঞ্চল উড়াইয়া দিয়াছিল। খোরশেদকে দেখিয়াই সে থমকিয়া দাঁড়াইল শিরায় শিরায় তাহার বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল। কী বিড়ম্বনা!
গিরির সুগঠিত দেহের দিকে খোরশেদ তাকাইল না। সে সোজাসুজি শ্যামসুন্দরের বাড়ির দিকে চলিয়া গেল। সে হয় তো গিরিকে দেখিতে পায় নাই।
গিরি দ্রুতপদে জল আনিতে চলিয়া গেল।
শ্যামসুন্দর খোরশেদকে দেখিয়া কহিলেন–“এই দুপুর রোদে কষ্ট করবার কী দরকার?” খোরশেদ ব্যথভাবে কহিল–“বাড়ির কাজ তো বিশেষ কিছু নেই কাকা! দিদিমণির, আপনার এবং কাকীর জন্যে কচি ডাব এনেছি মাত্র।”