খোর–কথায় আছে–বাঘের বাচ্চা বাঘ হয় শেয়ালের বাচ্চা শেয়াল। যাই বলেন, হামিদের সঙ্গে আমেনার বিয়ে হতে পারে না। আমার তা হলে মুখ দেখাবার যো থাকবে না। আমি এতে কোনো মত দিতে পারি না। আপনার কোনো বুদ্ধি নাই, কারণ মেয়ে মানুষ আপনি।
নফিসা–হামিদ কোন্ দিক্ দিয়ে মন্দ? সে কি আমেনার ভাই খোশেদের চেয়ে ছোট? তুমি কি তার চেয়ে শিক্ষিত? তুমি কি তা চেয়ে উন্নত ও ভালো লোকের সঙ্গে মিশতে পার?
খোর–হ্যাঁ মা, লেখাপড়া শিখে সে একটু ভদ্র হয়েছে। কত চাষার ছেলে লেখাপড়া শিখে ভদ্র হচ্ছে–আসলে তারা চাষা।
নফিসা–তবে কোথায় আমেনার বিয়ে দিতে চাও? যে ছেলেটার কথা তুমি বলছিলে আমি তাকে পছন্দ কত্তে পাচ্ছিনে।
খোরশেদ-এ-বংশের সঙ্গে সম্বন্ধ করলে আমাদের যে মর্যাদা আছে তার চেয়ে আরো বেড়ে যাবে। ভদ্রলোকেরা আমাকে বেশি করে ডেকে বসাবে। তা ছাড়া আমারও ভালো ঘরে বিয়ে হবে। আশরাফ শ্রেণীতে ভালো রকমে সাবেত হতে পারে। একটু ভালো হসব নসব না করতে পারলে কি আর ভালো হয়!
নফিসা মনে মনে হাসিলেন। ক্ষণেক নিস্তব্ধ থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন–“ছেলেটির নাম কী?”
খোর–বর্ধমানের করিমপুর নিবাসী মুন্সী নজীর মোহাম্মদ কাজীর পুত্র এনায়েত আলী একটি পাত্র। যেমন রূপ তেমনি গুণ। তার তেজ কী? নজীর সাহেবের গরু, ঘোড়া সারা মাঠে খেয়ে বেড়ায়, কোনো বেটার সাধ্য নাই কিছু বলে। এক চাড়াল-বেটা ছোটলোক, তার গরু দিয়েছিল খোয়াড়ে–লোকটির নাকি খালি মাত্র একখানা ঘর-পরণের কাপড় ছেঁড়া-বিনা চিকিৎসায়, পয়সার অভাবে তার ছেলেটি নাকি মারা গিয়েছিল–মাঠে মাত্র তার তিন বিঘা জমি, তাইতে তার বুকের এত বল–সে দিয়েছিল আবার নজির সাহেবের গরু খোয়াড়ে। তার থোড় ধান নাকি তোমার বেয়াইয়ের ঘোড়াতে পয়মাল করে দিয়েছিল। নজীর সাহেব হাটের মধ্যে তাকে জুতা-পেটা করেছিলেন। সারা বর্ধমান জেলার মধ্যে তাদের সমকক্ষ তোক আর নাই। মানুষকে জুতাপেটা করবার জন্য তাদের একখানা প্রকাণ্ড দালান আছে।
নফিসা–সাত নদী পার সেই দূরদেশে গিয়ে কি আমেনা সেখানে থাকতে পারবে?
খোর–ঐটি হচ্ছে মা তোমার বোকামি। যত দূরদেশ হয় তত কদর বাড়ে। লোকে জিজ্ঞাসা করবে বোনের বিয়ে হয়েছে কোথায়?–আমি বলবো বর্ধমানে। দূরদেশের নাম করতে কেমন গৌরব বোধ হয়, বলুন, দেখি–হুঁগলী, বর্ধমান, বীরভূম, রাজশাহী, ঢাকা। কেমন শোনা যায়! আরো যখন জিজ্ঞাসা করবে–বিয়ে হয়েছে কোন্ বংশে? বলবো বর্ধমানের জমিদার কাজী নজীর মোহাম্মদের পুত্র এনায়েত মিঞার সঙ্গে। অতি উচ্চ বংশ শরীফ খানদান। লোকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকবে।
নাফিসা–এত কোনা-কানাচের সংবাদ কোথা থেকে সংগ্রহ করলে? যেতে তিন দিন লাগে। আমরা গরীব মানুষ–তাদের সঙ্গে আমাদের মিল হবে না। নিজের অবস্থাকে গোপন করে বিয়ে দেওয়া ঠিক নয়, পরে বিপদ হবে।
খোর–ঘটকের নিকট থেকে সব তথ্য সংগ্রহ করেছি। বিয়ে যদি এক বার দিয়ে ফেলতে পরি–তবে আর ভয় নাই। কে আমাদের প্রকৃত অবস্থার কথা জানতে পারবে? ঘটক শাহাদত মিঞা তাদের কাছে বলেছেন আমরা জমিদার। ঘটক আমাদেরই লোক।
নাফিসা–বড়লোক যখন ছিলাম তখন ছিলাম–এখন আমরা গরিব মানুষ। এসব জাল-জুয়াচুরি দিয়ে কাজ কী বাবা?
খোরশেদ ক্রোধে মাকে নানা অকথা বলিল; মা তার ছোট ঘরের মেয়ে। তাকে বিয়ে করে খোরশেদের বাপের অনেক কলঙ্ক হয়েছিল! ইত্যাদি।
.
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
কয়েক দিন পর খোরশেদ করিমপুরে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। কলিকাতা হইতে অল্প দামে কেনা এক স্যুট, পুরানো সাহেবি পোশাক, পরিয়া খোরশেদ নজীর মিঞার বৈঠকখানায় সম্মুখে পায়চারি করিতেছিল। সঙ্গে ছিলেন শাহাদাত মিঞা। এই ভদ্রলোক উপায়ান্তর না দেখিয়া সম্প্রতি কয়েক বৎসর হইতে এই ব্যবসা আরম্ভ করয়াছেন। দুই বৎসর পূর্বে বর্ধমানে কাপড়ের ব্যবসা করিতে আসিয়াছিলেন। সেই উপলক্ষে নজীর মিঞার সঙ্গে তাহার যথেষ্ট বন্ধুত্ব জন্মিয়াছিল বৈঠকখানার সম্মুখে আর কেউ ছিল না। শুধু শাহাদাত আর খোরশেদ।
নজীর মিঞা, খোরশেদ ও পুরাতন বন্ধু শাহাদত মিঞাকে যথেষ্ট সম্ভ্রমের সহিত গ্রহণ করিয়াছিলেন। বস্তুত তাঁহাদেরই আহারের জন্য বাড়ির ভিতর তিনি পোলাও-কালিয়া কোর্মার ব্যবস্থা করিতেছিলেন। এনায়েত আলী সম্বন্ধীর সহিত আলাপ করিতে লজ্জাবোধ করিয়া ঘরের মধ্যে বসিয়াছিল। বয়স তাহার পঁচিশ-মধ্য ইংরেজি স্কুলে নাকি ফাস্ট ক্লাশে পড়ে।
শাহদাত বলিল–“আরে বাপু এসেছি যখন তখন ইনশাআল্লাহ কাজ হাসিল করে যাবোই যাবো।”
খোরশেদ–খোদার মরজি, আর আপনার দোয়া। বোন আমার বড় হয়েছে। বিয়েটা কোনো গতিকে হয়ে গেলেই হয়। তার পর আর ভয় নাই।
শাহদাত–তোমার বুদ্ধি হয়েছে বাবা। সেয়ানা ছেলে, বই থুয়ে কোথায় পালাবে? কোনো রকমে বিয়েটা হলেই কাজ ফতে।
খোরশেদ-জমিদার বলেই বোধ হচ্ছে। বিয়ে যদি হয় তা হল দেশে খুব নাম হবে, তার আর কোনো ভুল নেই। এমন নসর আমার বাপও করে যেতে সক্ষম হন নাই। খোদার কলম কে রদ করবে? তার অনুগ্রহে সব হয়।
শাহদাত–আরে বাবা এত বড় জমিদার আর এ-তল্লাটে নেই, তবে কিনা একটু কৃপণ। অনেক কিছু চার্জ করবে। কিছুতেই পেছপাও হয়ো না। লেখাপড়া শিখে আর কে নাম করতে পারে? ভদ্রলোকদের সহিত কাজ-কর্ম করে যা হয়।