পরক্ষণেই লজ্জিত হইয়া করিমা আবার ভাবিল–রায়হান বড় সুন্দর ও মহৎ। আমার প্রাণের ভিতরে তার মহত্ত্বের কথা ঘুরে ঘুরে বেড়াতে চায় সত্য–কিন্তু তার সঙ্গে আমার কথা না বলাই ভালো হবে কেন? বড় কর্তব্যের সামনে মনের এই অতি মূল্যহীন খেয়ালকে স্থান দেওয়া ছেলেমি। ওটা কিছু নয়। নারীর বেদনা ও দৈন্য আকাশ-পাতাল কাঁপিয়ে। দিচ্ছে। একদিকে সে মুখ, অন্যদিকে সে সম্পূর্ণ নিঃসহায়; জীবন তার আবর্জনাবিশেষ। নিঃস্ব, পরাধীন, মূল্য ও শক্তিহীন বিধবা দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করলেও তার অসম্মান ছাড়া সুখ হয় না। নারীর হাতে অর্থ এবং বুকে বল চাই। রুক্ষকেশা শুক্ল বস্ত্রপরিহিতা নিরাভরণা। করিমা আকাশের দিকে চাহিয়া কেবলই চিন্তা করিয়া যাইতেছিল। উজ্জ্বল লোহিত ললাট তার স্বেদ সিক্ত হইয়া উঠিল। কোমল করুণাভরা বিভ্রান্ত দৃষ্টি কাঁপিয়া কাপিয়া উঠিতেছিল। ভাব ও বেদনাবোধে তার রক্ত চিবুক থাকিয়া থাকিয়া স্ফূরিত হইয়া পড়িতেছিল। করিমার মূর্তি খানি কী পবিত্র! কী সুন্দর! কেবল শুভ্রগন্ধ ও সুষমার একখানা উজ্জ্বল মোহন ছবি।
দরজায় ধাক্কা দিয়া এমন সময় খোরশেদ মুখ বাড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল–“হামিদ এখানে আছে?”
করিমা উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন–“কে, খোরশেদ নাকি? টাউনে গিয়াছে, তুমি জান না?”
“জানি” বলিয়া খোরশেদ কহিল–“মনে ছিল না।”
খোরশেদ আবার দাঁড়াইয়া থাকিয়াই বলিল–“যাই এখন বুবু!”
করিমা কহিল–“কেন, এত তাড়াতাড়ি কীসের? এসেছ যখন, তখন বসো।”
“চাচি কই?”
”রান্না ঘরে।”
“এখনও ঘরে প্রদীপ দেওয়া হয় নাই যে?”
“কেন, অন্ধকারে বসে থাকলে দোষ কী?”
দোষ নাই–জিজ্ঞাসা করালাম আর কী।”
এমন সময় করিমার ছোট ভাইটি আসিয়া তাহার বুবুকে জড়াইয়া ধরিল। করিমা প্রদীপ জ্বাললেন।
খোরশেদ একখানা চেয়ার টানিয়া উপবেশন করিল। করিমা কহিলেন–“খোরশেদ, তুমি পড়া ছেড়ে দিলে কেন?”
“প্রতিজ্ঞা করেছি, হিন্দুর স্কুলে আর পড়বে না।”
“কেন?”
“হিন্দুর স্পর্শে আসা মুসলমানের পক্ষে পাপ।”
করিমা হাসিয়া কহিল–“বেশ খেয়াল তোমরা মাথায় চেপেছে।”
খোরশেদ কথা কহিল না, অন্যমনস্ক হইয়া বসিয়া রহিল। করিমা বিছানার উপর বসিয়া খোকাকে লইয়া আদর করিতেছিল।
খোরশেদ কম্পিত-কণ্ঠে কহিল–“করিমা তোমার একখানা চিঠি আছে।”
করিমা হাত বাড়াইয়া বিস্ময়ে কহিল–“দেখি, কোথা হতে এসেছে? পিওন তো বিকেল বেলাও এসেছিল।”
খোরশেদ কথা বলিল না। পকেট হইতে একখানা খাম বাহির করিয়া করিমার তুষারশুভ্র হাতের উপর রাখিল এবং মুহূর্তের মধ্যে কাহাকেও কিছু না বলিয়া সে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেল।
খামের উপরে লেখা ”প্রাণের করিমা” আর কিছু নয়।
করিমার হাতখানি কাঁপিয়া উঠিল। কী বিস্ময়! চিঠিখানি সে দূরে ফেলিয়া দিতে চাহিতেছিল, কিন্তু ভুলও তো হইতে পারে।
ধা করিয়া খামের মুখটা ফাড়িয়া সে যাহা দেখিল তাহাতে তাহার কাছে যেন সমস্ত ধরণীটা অগ্নিময় হইয়া উঠিল। যাহা স্বতীত, যাহা কল্পনায় আসে না–তাহা করিয়া চোখের সম্মুখে দেখিল। তাহাও আবার খোরশেদের নিকট হইতে! ধিক্ তাহার অদৃষ্টকে!
ঘৃণায় চিঠিখানা কুটি কুটি করিয়া পায়ের নিচে দলাইয়া সেগুলি বাহিরে ফেলিয়া দিল। ঘৃণিত সংসার! মানুষের মন কী বিচিত্র!
১১-১৫. ইহার পর এক বৎসর
একাদশ পরিচ্ছেদ
ইহার পর এক বৎসর কাটিয়া গিয়াছে। পুত্রকে একদিন নফিসা বলিলেন–“বাবা খোরশেদ, হামিদ যখন প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে, তখন আমেনাকে তার হাতে দেওয়ায় বাধা কী? হামিদের মা বার বার গোপনে আমাকে একথা বলেছেন। হামিদ আমেনাকে বিয়ে করবার জন্য ভারি উৎসুক। তোমার মত না হলে কী করে কী হবে, বল? তুমি তো আর ছোট নও। জাতির গৌরব করে আর কী হবে, বল?”
খোরশেদ। মা, তুমি কী পাগল হলে?হমিদ বি-এ পাশ করলেও তো আমার বোনকে বিয়ে করতে পারে না। লোকের কাছে তাতে আমাদের মাথা হেঁট হবে। চিরকাল আমরা আমাদের বংশ মর্যাদা রেখে এসেছি। আমা হতে তা নষ্ট হলে আমার মনে ভয়ানক দুঃখ হবে। এ কাজে আমার জাত থাকবে না।
নফিসা। এই যে বংশমর্যাদার বড়াই, এটা বাবা কিছু নয়। মাংসহীন শুকনো হাড় নিয়ে টানাটানি করলে কী হবে? তোমার মামু জোনাব মিঞা বংশের বড়াই করে দুই-মেয়েকে হাতি করে রেখেছিলেন। ত্রিশ বছর উতরে গিয়েছিলো তবুও বিয়ে দিলেন না। এটা কি
ভদ্রতা? দেশে কি একটা মানুষও নাই যে তার মেয়ের উপযুক্ত হতে পারে? তাই যদি তিনি মনে করেন তাবে তার এদেশ ছেড়ে অন্য দেশে যাওয়া উচিত ছিল। বাবা! বেশি বড়াই করা ভালো নয়। আল্লার আলমে শুধু আমরাই ভদ্রলোক একথা মনে করো না!
খোর–উপযুক্ত বর না পেলে মেয়েকে কি লোকে ফেলে দেবে? অসভ্য লোকের মধ্যে কি মার্জত রুচি ব্যক্তিরা বাস করতে পারে? পদে পদে তাদিগকে অপদস্ত ও আহত হতে হয়।
নসিফা –তাই বলে কি চিরকাল মেয়েকে বিয়ে না দিয়ে রাখতে হবে? ভদ্রলোক তুমি কাদিগকে মনে কর? পুরোনো লোকের মধ্যে যারা উচ্চশ্রেণীর বংশ বলে দাবি করে তাদের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে বহু নীচতা আছে। আমার মনে হয় তাদের ভদ্রতা তাদের মনের মধ্যে না থেকে কায়দায় যেয়ে দাঁড়িয়েছে। আধুনিক শিক্ষিত যুবকেরা সেইসব পুরোনো ভদ্রলোকদের চেয়ে বড়।