তাহার পর ”আসি” বলিয়া সে পিছন ফিরাইয়া দাঁড়াইল।
বিনোদিনী ব্যস্তভাবে অগ্রসর হইয়া খোরশেদের হাত ধরিয়া কহিলেন : ‘তুমি আজ বাড়ি যেতে পারবে না। এস আমাদের বাড়ি। তোমাকে নিজ হাতে খাওয়াব।”
খোরশেদ আপত্তি তুলিল না। বিনোদিনী অগ্রে, গিরি মধ্যে এবং পশ্চাতে খোরশেদ চলিল।
শ্যামসুন্দর যখন আনুপূৰ্কি ঘটনা শুনিলেন তখন কৃতজ্ঞহৃদয়ে বলিলেন, বাবা খোরশেদ! তুমি আমাদের পর নও। আজ থেকে তোমাকে আমি অধিক করে ভালবাসবো।”
খোরশেদ। আমাকে লজ্জা দিচ্ছেন কেন? আমি কী করেছি?”এর চেয়ে বড় কাজ কে কত্তে পারে?”
তারপর কথায় ও প্রশংসায় ঘণ্টা খানেক কাটিবার পর বিনোদিনী একটা পাকা পেঁপে, দুখানা সন্দেশ এবং খানিক দুধ লইয়া আসিয়া কহিলেন–“মা গিরি, এইগুলি ধর দেখিন, খোরশেদকে দাওয়ায় বসিয়ে নিজ হাতে খাওয়াব। পেঁপেটা বাক্স থেকে ছুরি এনে কেটে দাও। আর জন্মে ও হিন্দু ছিল।”
গিরি, “আনি” বলিয়া পেঁপে ও সন্দেশের ডালা ও দুধ-খানিক গ্রহণ করিল।
আর আপত্তি করিলে লাভ হইবে না ভাবিয়া খোরশেদ কোনো কথা না বলিয়া আসনে বসিয়া পড়িল।
শ্যামসুন্দর অন্ধকারে ঘরের ভিতর তামাক খাইতে লাগিলেন।
বিনোদিনী কহিলেন”তুমি সঙ্কোচ বোধ করো না খোরশেদ। নিজের বাড়ির মতো বসে খাও। এঠো আমি নিজেই পঙ্কিস্কার করবো, তাতে আমায় স্নান করতে হবে না।
.
দশম পরিচ্ছেদ
এই দুঃখ ভরা সংসারে শান্তির আনন্দ কোথায়?–পরের উপকার করিয়া যে দীন ও নিরাশ্রয়কে তাহার হাত ধরিয়া-মূর্খকে জ্ঞানের আলো দিয়াছে।
স্নিগ্ধ রজনীর অঞ্চল উড়াইয়া ধীর সমীরণ করিমার মুখে আসিয়া লাগিতেছিল। করিমা অস্ফুট স্বরে কহিল–“পথহীনকে পথ দেখাইয়া-মূর্খকে জ্ঞান দান করিয়া।”
সে জানে তার জীবন শুষ্ক ও মরুময়। কোথায়ও একটু আনন্দ নাই। পিতা পুনরায় বিবাহ দিবার জন্য তাহাকে তৃতীয় ব্যক্তির দ্বারা অনুরোধ করিয়াছিলেন। করিমা সন্দেহ ও অবিশ্বাসে কিছু বলে নাই।
জীবনের এই শুষ্কতার ভিতর প্রাণের এই ভয়াবহ নির্জনতার প্রতিদান কি শুধু এই পুরাতন সংসারের স্থবির দিনগুলি একই রকম খেলা, কথা ও কাজ?
তার জীবনের উদ্দেশ্য কী? শুধু বাঁচিয়া থাকা। জীবন কি তার শুধু বিড়ম্বনাময়-নিরর্থক!
সেদিন জ্যোছনালোকে সে একটা অতীতের স্বপ্ন দেখিয়াছিল। কিন্তু তাহা ভাবতে সে সাহস পায় নাই। সেই যুবকের প্রশান্ত সৌম্য মূর্তির মধ্যে একটা অতীত স্বর্গ আবেগের বন্যা তাহার মনের উপর দিয়া খেলিয়া গিয়াছিল। নিজের মনে অবাক হইয়া সে বলিয়াছিল ”তওবা”।
একটা কিছু করা চাই। এমনি করিয়া ছেলেখেলার মধ্যে মানুষের মনটাকে কিছুতেই ডুবাইয়া রাখা যায় না। আত্মার স্বভাবজাত অতৃপ্তির সম্মুখে ইন্ধন যোগান চাই। নহিলে সে। বাঁচে না।
করিমা ভাবিল, দুঃখী ও অন্ধ মানুষকে ভালবাসিয়া সে তাত্ত্বিক আনন্দ সংগ্রহ করিবে। মানুষের শিশুকে বুকে লইয়া সে সুখী হইবে।
করিমা আবার ভাবিতেছিল–সেই সে ভিখারির মেয়েটা সেদিন এসেছিল। চারবার তার নিকে হয়েছিল,তবুও সে বিধবা। দ্বিতীয় ও চতুর্থ স্বামী তালাক দিয়ে তাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। সে কাল, এই তার অপরাধ। কী করে তার চলবে? মেয়ে মানুষের জন্য সংসারে কাজ আছে? শুধু মানুষের উপর নির্ভর করে কি বেঁচে থাকা যায়? অনেক দিন হইতে সে নিজেকে প্রশ্ন করিয়া আসিতেছে–মেয়ে মানুষকে যদি একটা অর্থকরী কাজ শিখিয়ে দেওয়া যায়–তা হলে সে নিজেই অন্ন সংগ্রহ করবার ক্ষমতা পেতে পারে। এটা সম্ভব কী?
সেই হতভগিনী মেয়েটি সম্বন্ধে আবার তাহার চিন্তা আসিল। আহা, মেয়েটি কাল হলেও তার চেহারায় একটা স্বর্গীয় লালিত্য ফুটে উঠেছে। মাত্র তার বয়স পঁচিশ। মরতে। এখনও বহু বৎসর বাকি। কী করে সে এতকাল বেঁচে থাকবে? খোদার দেওয়া আত্মার প্রতি এত অবহেলা কী সহ্য হয়?
প্রতি শুক্রবারে কত ভিখারিনী এসে দরজায় হাঁক ছাড়ে। কার ঘরেই বা কত চাল পয়সা আছে? এই সহস্র হতভাগিনীদের দুঃখ বেদনার জন্য কে দায়ী? কে তাহাদিগকে এমন করেছে? তারা ছোটলোক–এখানে ওখানে যেতে পারে। ভিক্ষেই হোক আর যাই হোক বাচবার জন্য তারা কিছু চেষ্টা করতে পারে। অসহায় ভালোমানুষের ঘরের মেয়েরা কী করবে? তারা কী করে বাঁচবে? মেয়ে মানুষের জীবন কি দুঃখময়! তা ছাড়া মূল্যহীন জীবনের আদর স্বামীর ঘরেও হয় কি? ন্যায্য দাবি না থাকলে কে কাকে মানে? তাদের জন্য সে কি তার ক্ষুদ্র শক্তি ব্যয় করিয়া কিছু করতে পারে না? সত্য রকমে তাদের জন্য তার। মতো সামান্য নারী কী করতে পারে?
করিমা-আকাশ-পাতাল ভাবিল, কিন্তু কোনো মীমাংসা হইল না।
করিমা আবার ভাবিল–মানুষ লেখা-পড়া না শিখলে পশু হয়–সে কিছু বুঝতে পারে।মেয়ে মানুষের বোঝবার যদি ক্ষমতা থাকতো তা হলে তারা তাদের অবস্থার কথা ভেবে, না কেঁদে থাকতে পারতো না। বাপের যদি একটা ছেলে আর একটা মেয়ে হয়। পিতা পুত্রের মঙ্গলের জন্য দশ হাজার টাকা ব্যয় করেন। মেয়েকে অন্ধ ও মূর্খ করে বিয়ের নামে তাকে জন্মের মতো তাড়িয়ে দেন। ডেপুটি ইন্সপেক্টর মৌলবী এমদাদ আলীর হঠাৎ মৃত্যুর পর আহা! তার প্রৌঢ়া বৌটির কী দূরবস্থাই না হয়েছিল! এমন ভদ্রঘরের মেয়ে সারা জীবনটা তার দুঃখে দুঃখে কেটে গেছে। আহ্ কি বেদনা–কি যাতনা! এর মীমাংসা কী? সব সময়ে সব অবস্থায়ই দ্বিতীয় বিয়ে সম্ভব? সহসা উফুল্লা হইয়া করিমা বলিয়া উঠিল–দৃষ্টি সম্পন্ন চিন্তাশীল পরোপকারী রায়হানকে এই সব কথা বল্লে সে কি বলে জানা যাবে। আমার মনের এই বেদনার কিছু মূল্য আছে কিনা তার কাছে শুনে দেখলে হয়। সে তো অনেক কথা ভাবে-হৃদয় তার মমতাভরা, এই গুরুতর কথাটা কি তাকে কোনোদিন। আঘাত করে নাই? কিন্তু সহসা করিমা ঈষৎ শিহরিয়া উঠিয়া ভাবিল–কোনো কারণে হয়তো তার সঙ্গে আমার কথা না বলাই ভালো।