“তোমার ভয়ানক অপরাধ হয়েছে। বিদ্যালয়ের ছেলেদের পক্ষে পথের মাঝে বাজে লোকের সঙ্গে বচসা করা আইন বিরুদ্ধ। তুমি কোন সাহসে অসঙ্কোচে একটা যুবতী মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে সাহস করেছিলে?”
“আমি কথা বলি নি।”
“তুমি কথা বল নাই?”
“সেই আমাকে প্রথমে অতি জঘন্য অপমানজনক কথা বলেছিল।”
“কথাটা কি?”
“এই যেমন মুসলমানেরা আপনাদিগকে গোলাম, উঁটা বা কাফের বলে ঠিক সেই ধরনের কথা।”
“যাক, শুনতে চাই না। তোমাকে গালি দিয়েছিলো–তুমি তার বাবাকে কেন বলে দিলে না?”
“এই মিষ্টিমধুর কথাগুলি হিন্দু ছেলেমেয়েরা তাদের মা-বাবার কাছেই শেখে; সুতরাং তাদের কাছে নালিশ করা আর নিজকে বেশি করে অপদস্থ করা একই কথা। ক্ষমা করবেন, এরূপ উপদেশ আর আমাকে দিবেন না।”
বিনয় বাবু বিরক্ত হইয়া বলিলেন–“তুমি তো বড় পাজি হে। তুমি কোন কালে শুনেছো কোনো হিন্দু তার পুত্র-কন্যাকে এইসব কথা শিখাচ্ছে?”
“পাজি হতে পারি, কিন্তু এটা সত্য কথা!”
“তুমি শ্যামসুন্দর বাবুর মেয়েকে মেরেছিলে–কেমন?”
“মেরেছিলাম। শুধু তাকে নয়, রমেশকেও এ একই কারণে অপমান করেছি।”
“বটে, তোমার এত সাহস?”
“সাহস না হয়ে উপায় কি! হিন্দুর এই রোগের ঔষধ কর্ণ মর্দন ছাড়া আর কিছুই নয়। আজ যে হিন্দু আমায় অপমানসূচক গালি দিতে সঙ্কোচ বোধ করে না–কালই সে বিপদে পড়লে ভগবানের অংশ বা দেবতা বলে আমাকে নমস্কার করবে।”
ক্রোধের মাথায় কথাগুলি বলিয়া ফেলিয়া খোরশেদ থতমত খাইয়া গেল। বিনয় বাবু অগ্নিশর্মা হইয়া “দপ্তরি দপ্তরি” বলিয়া চিৎকার করিতে লাগিলেন।
দপ্তরি আসিতেই বিনয়বাবু হুকুম দিলেন–“এই ছেলেটিকে কান ধরে বের করে দাও।”
কিন্তু তাহার পূর্বেই দুঃখে ও ভয়ে খোরশেদ লাইব্রেরি পরিত্যাগ করিয়াছিল।
এক ঘণ্টার মধ্যে দপ্তরি সার ক্লাসে নোটিশ দিয়া আসিল–“অদ্য খোরশেদ মিঞার মাথায় স্কুলের ছুটির পর সর্বসমক্ষে গাধার টুপি পরান হইবে।”
.
নবম পরিচ্ছেদ
সেইদিন হইতে কয়েক মাস খোরশেদ স্কুলে যায় না। বাড়িতেই সে থাকে। মাঠের জমি দেখিয়া এবং বাপের কালের প্রজাদের নিকট হইতে খাজনা আদায় করিয়া তার দিনগুলি কাটিয়া যায়।
মিত্রপুকুরের বাঁধানো ঘাটে তখন আঁধার জমিয়া উঠিয়াছিল। ঘাট হইতে সেই অল্প আঁধারকে সরাইয়া ফেলিয়া একটা যুবতী উপরে উঠিলেন।
যুবতী দেখিলেন, ওমা একি? তার সম্মুখে খোরশেদ। খোরশেদ আড়ষ্ঠকণ্ঠে বলিল,–“গিরি, আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি। অনেক দিন থেকে সুযোগ খুঁজছি, কিন্তু পাই নাই।”
রূপময়ী গিরিবালা দেখিল–সুঠাম সুগোল-দেহ খোরশেদ পোষমানা ব্যাঘের মতো তাহার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। গিরিবালার সে চপলতা আর এখন নাই। সংসারের অনেক কথাই সে ভাবিতে শিখিয়াছে। সে দেখিল–বিনয়াবনত খোরশেদের মুখে একটা তরল মহিমার দীপ্তি ফুটিয়া উঠিয়াছে। দুর্দান্ত খোরশেদ যে কাহাকেও ভয় করে না সে আজ তাহার সম্মুখে বিনয়ে নম্র। কী বিস্ময়!
পুলক ও গৌরবে গিরিবালার মন ভরিয়া উঠিল। সে নম্র-মধুরকণ্ঠে কহিল–“ক্ষমা, কীসের ক্ষমা খোরশেদ? আমি কিছু মনে করি নাই।”
খোরশেদ আবগভরা কণ্ঠে বলিল–“গিরি, তোমার মন এত বড়! তুমি কি দেবী? তুমি আমার মতো নরপিশাচকে এত সহজে ক্ষমা করলে? ওঃ তুমি বড় মহৎ–আমি তোমায়। ভালবাসি।”
জীবনের যে সময় কোনো অজ্ঞাত অনুভূতির লালসায় মানুষের মন অজ্ঞাত সারে উন্মুখ হইয়া থাকে, তখন কেউ যেন এই অতি মধু অথচ ভয়ানক কথাটি কাহাকেও না শুনায়।
গিরির গণ্ড সহসা স্বেদসিক্ত হইয়া গেল। তাহার কাকাল হইতে কলসিটি পড়িয়া একেবারে বেঁকা হইয়া শব্দের সহিত জলের ভিতর পড়িয়া গেল।
দূর হইতে একটি প্রদীপ লইয়া কে একজন ডাকিয়া উঠিলেন–গিরি, এত দেরি হচ্ছে কেন? তোর বাবা যে জলের জন্য বসে আছেন।”
মুহূর্তের মধ্যে গিরি ব্যস্ত হইয়া উঠিল। অন্ধকারাচ্ছন্ন সন্ধ্যাকালে সে কাহার সহিত কথা বলিতেছে?
গিরি চিৎকার করিয়া বলিল–“মা,আমায় এগিয়ে নিতে এসেছ! আমি ডরিয়ে মরছিলাম। ভাগ্যে এই ছেলেটা এসে ঘাট থেকে আমায় টেনে তুলেছে।
গিরির মা বিনোদিনী বিস্ময় ও ভয়ে বলিলেন–“মা, এই বাড়ি-এর মধ্যে কি এসেছে?”
বিনোদিনী মেয়ের সম্মুখে আসিয়া দেখিলেন–গিরির কাপড় ভিজে।
“ওমা,কি কথা?”–বলিয়া খোরশেদের দিকে ফিরিয়া বিনোদিনী জিজ্ঞাসা করিলেন কে বাবা তুমি? তুমি কি আমাদের গ্রামের ছেলে?”
একটা দমকা বাতাস আসিয়া বিনোদিনীর হাতের প্রদীপটি নিবিয়া গেল।
খোরশেদ বলিল–“আমি খোরশেদ, গিরি জলের পার্শ্বে সিঁড়ির উপর পড়ে ওমা, ওমা বলে আর্তস্বর চিৎকার কচ্ছিলো–আমি দৌড়ে এসে টেনে তুল্লাম।
বিনোদিনী চোখের জল ফেলিয়া বলিলেন–“বাছা! তুমি খোরশেদ–আহা, আর জন্মে তুমি আমার ছেলে ছিলে! তুমি এ পথ দিয়ে না গেলে যে মেয়ে আমার ডুবে মরে যেত।“
উদ্বেগ,ব্যগ্রতায় বিনোদিনী ভয়ের কারণ জিজ্ঞাসা করিতে ভুলিয়া গিয়াছিলেন। এইবার মেয়ের দিকে ফিরিয়া উৎকণ্ঠা-আশঙ্কায় জিজ্ঞাসা করিলেন–“কী হয়েছিল মা?”
গিরি বলিল–“কী যেন আমার পায়ের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল। একে বারে উপুড় হয়ে পড়ে গড়াতে জলের ভিতর, যেয়ে পড়ছিলাম। গলা আমার বন্ধ হয়ে এসেছিল। ভাগ্যে খোরশেদ বাবু এসেছিলেন।“
খোরশেদ বলিল–“আমি বাবু নই–আমি মিঞা।”