এমন সময় শ্যামসুন্দর ও নগেন ঘোষ আসিয়া উপস্থিত হইলেন। শ্যামসুন্দরের মাথায় একখানা ভিজা গামছা জড়ান ছিল।
রায়হান সম্ভ্রমে শ্যামসুন্দরকে বসিতে অনুরোধ করিলেন।
দারোগা বাবু রায়হানের আশ্চর্য ব্যবহারে মনে মনে চমৎকৃত হইতেছিলেন। ভাবিলেন, এমন ব্যক্তি তো কখনও দেখি নাই।!
শ্যামসুন্দরের মনে যাহাই থাকুক, অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয়, তিনি রায়হানের কুশল, জিজ্ঞাসা করিতে ভুলিলেন না। নগেন ঘোষ চুপ করিয়া রহিল।
অধিক বিলম্ব হইল না। বিরক্ত ও বিস্ময়ে গ্রামের সব ভদ্রলোক আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
রায়হান, দারোগা বাবু ও অন্যান্য ভদ্রলোকদিগকে বসিবার সুবিধা করিয়া দিয়া যৌন হইয়া এক পার্শ্বে দাঁড়াইয়া রহিলেন।
আলোচনায় প্রমাণ হইল–যে সময়ের কথা উল্লেখ করিয়া রায়হান ও খোরশেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনয়ন করা হইয়াছে তখন তাহারা স্টেশনে উপস্থিত ছিলেন।
খোরশেদের বাড়িতে গত রাত্রে মিলাদ পাঠ হইয়াছিল। সেখানে যাহারা সমবেত হইয়াছিলেন তাঁহারা অবলা সরলা নারী মাত্র। তাহারা রক্তচক্ষু লাঠিয়াল নহে। তাহাদিগকে ভয় করিয়া গ্রাম ছাড়িয়া কাহারো পলায়ন করিবার দরকার ছিল না।
দারোগাবাবু বুঝিলেন,ব্যাপারের মূলে কিছুই নাই। কিন্তু তাহার মনে প্রশ্ন হইতে লাগিল রমেশের দাঁত ও নাক কে ভাঙ্গিয়া দিয়েছে? মিথ্যা মোকদ্দমা সৃষ্টি করিবার জন্য ইহা কি তার বাপেরই একটা কারসাজি?
দারোগা অনেকক্ষণ অবাক হইয়া থাকিয়া খেলো ঘটনাকে অধিক ফেনাইয়া না তুলিবার ইচ্ছায় রায়হন ও অন্যান্য ভদ্রলোকদের সহিত অমায়িকভাবে করমর্দন করিয়া সেখান হইতে অশ্বপৃষ্টে প্রস্থান করিলেন।
শ্যামসুন্দর মৌন হইয়া বসিয়া থাকিয়া রহিলেন। সকলে মিলিয়া তাহাকে ঘিরিয়া বিদ্রূপ বাণ বর্ষণ করিতে লাগিলেন। হিন্দুরা খেয়ালের বশবর্তী হইয়া মুসলমান
ভদ্রলোকদিগকে অপ্রস্তুত করিবার জঘন্য চেষ্টা কেন করিতেছেন, ইহাও কেহ কেহ প্রশ্ন করিলেন। ক্রমশ তাহাদের স্বর উত্তেজিত ও রুক্ষ্ম হইয়া উঠিল।
ব্যাপার খারাপ হইতে পারে বিবেচনা করিয়া রায়হান শ্যামসুন্দরকে প্রস্থান করিতে ইঙ্গিত করিয়া সকলকে মৃদুভাবে কহিলেন—”বিপদে পড়িলে মানুষ নানা ভুল করে বসে। হিন্দুদের ব্যবহারের আমাদের ক্ষুণ্ণ হওয়া উচিত নয়। গোলযোগ যে এইখানেই শেষ হল, এতে সকলেরই আনন্দ প্রকাশ করা উচিত। শ্যামসুন্দর বাবু ও অন্যান্য হিন্দুরা এইভাবে শঙ্কিত হবার যথেষ্ট কারণ ছিল।”
রায়হানের নিকট হইতে হরিবাবু স্টেশনে যাইয়া স্টেশন-মাস্টারের নিকট জানিলেন–গত রাত্রি ২টা হইতে সকাল পর্যন্ত রায়হানের সহিত তাহার ব্যবসা সম্বন্ধে আলাপ হইয়াছে। দারোগা হাসিয়া থানায় প্রস্থান করিলেন।
.
অষ্টম পরিচ্ছেদ
গিরিবালাকে প্রহার করিবার পর প্রায় সাতদিন ধরিয়া খোরশেদ স্কুলে যায় নাই। প্রথম তিনদিন বিনা কারণে সে কামাই করিয়াছিল। শেষ পাঁচদিন তাহাকে সাংসারিক কাজে টাউনে কাটাইতে হইয়াছিল।
মনটা একটু ভার করিয়াই সেদিন খোরশেদ ক্লাসের ভিতর বসিয়াছিল।
শিক্ষক যাহা বুঝাইতেছিলেন সেদিকে তাহার আদৌ মন ছিল না এমন সময় হঠাৎ দপ্তরি আসিয়া ক্লাসের শিক্ষক মহাশয়েকে বলিল–“হেড মাস্টার সাহেব খোরশেদ মিঞাকে ডাকছেন।”
গত সাতদিন খোরশেদ স্কুলে আসে নাই। তাহার মন বিনা কারণে আতঙ্কিত হইয়া উঠিল। শিক্ষকের অনুমতি লইয়া সে বাহিরে আসিল।
লাইব্রেরি ঘরে তখন আর কেহ ছিল না, শুধু প্রধান শিক্ষক বিনয় বাবু চেয়ারে বসিয়া একখানা চিঠি লিখিতেছিলেন।
খোরশেদ নিঃশব্দে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া বিনয় বাবুকে আদাব করিল। তিনি কথা কহিলেন না, শুধু একটু মাথা ঝুঁকাইয়া দপ্তরিকে বাহির যাইতে আদেশ দিলেন।
খোরশেদ দুর্দান্ত হইলেও শিক্ষকদের সম্মুখে সর্বদাই সে নম্র ও ভদ্র হইয়া থাকিত। তার ভিতরে যে কতখানি দুর্জয় ভাব নিহিত ছিল একথা কোনো শিক্ষক জানিতেন না।
অত্যন্ত ভয়ে খোরশেদ বিনয় বাবুর আজ্ঞার অপেক্ষা করিয়া মাথা নত করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। বুক তাহার দুরু দুরু করিতেছিল। কোনো দিন তো এমনভাবে হেডমাস্টার মহাশয় তাহাকে ডাকেন নাই। কেহ কি তাহার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনয়ন করিয়াছে? যে একটু ঘটনা হইয়াছিল তাহা তো এক রকম মিটিয়া গিয়াছে।
একটা উদ্বেগশূন্য দীর্ঘনিশ্বাস টনিয়া লইয়া খোরশেদ সোজা হইয়া দাঁড়াইল।
বিনয় বাবু এইবার মাথা তুলিয়া কহিলেন–“খোরশেদ! তোমার বিরুদ্ধে এক গুরুতর অভিযোগ আছে। হয় তোমার স্কুল পরিত্যাগ করতে হবে নইলে অতি কঠিন দণ্ড গ্রহণ করতে হবে।”
খোরশেদ অত্যন্ত বিস্ময়ে ও অত্যন্ত ভয়ে কহিল–“কী গুরুতর অভিযোগ মহাশয়? যদি অপরাধ করে থাকি তবে তার জন্য শাস্তিভোগ করতেই হবে। আমি যে কোনো অপরাধ করেছি এরূপ তো আমার মনে পড়ে না।”
বিনয় বাবু সহানুভূতি বর্জিত কঠিন কণ্ঠে বলিলেন–“তুমি শ্যামসুন্দর বাবুর কন্যা শ্রীমতি গিরিবালাকে মেরেছিলে?”
খোরশেদ তৎক্ষনাৎ কী উত্তর দিতে যাইতেছিল, কিন্তু কী কারণে সে চুপ করিয়া রহিল। প্রধান শিক্ষক মহাশয় আবার বলিলেন–“কেমন এই অভিযোগ সত্য?”
“সত্য।কিন্তু কেন অপমান করেছিলাম তা আপনি জানেন?”
“সে কারণ আমি জানতে চাই না। তুমি যে তাকে মেরেছ–এইটা ঠিক?”
“ঠিক–কিন্তু কারণ আমাকে বলতে হবে। আপনি না শুনলেও আমি বলবো। সে আমাকে অশ্লীল ভাষায় গাল দিয়েছিল কেন? সে তো অনেক দূরেই দাঁড়িয়েছিলো–তবু কেন বল্লে–জল নষ্ট হয়ে গিয়েছে। জল যে কোনো রকমেই নষ্ট হয় নাই এই কথাই তাকে ভালো করে জানিয়ে দিয়েছিলাম।”