বন্ধু, বাইরের কোনো বিধান, পুস্তকের কোনো বাক্য মানুষকে কী কৰ্তব্য কী অকর্তব্য, তা বলে দিতে পারে না। সমস্ত সময় মনকে জিজ্ঞাসা কর, কারণ মন আল্লাহর আসন–এখানে তার বাক্যের ধ্বনি জাগে।
.
পত্নীর আত্মীয়-স্বজন
১ম বন্ধু কহিলেন–একটা যুবকের কথা জানি, সে তার শ্বশুরকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিল এবং পত্নীকে বাপের বাড়ি যেতে দেয় না।
১ম বন্ধু–সে বড় অন্যায় কথা। পত্নীর পিতা এবং তার আত্মীয়স্বজন মাত্রকেই সম্মান করা উচিত। যিনি তা করেন না, তিনি বড়ই অন্যায় করেন। যারা তোমার পত্নীকে বাল্যকালে ভালোবেসেছে; সোহাগ করেছে, তার মঙ্গল কামনা করেছে, তাদের অসম্মান করা ভদ্রতা নয়। কোনো কারণে জামাই আপন শ্বশুরের উপর বিরক্ত হতে পারেন; কিন্তু তাই বলে অজ্ঞতার পরিচয় দেওয়া কোনোমতে উচিত নয়। পত্নীকে আটক করে রাখা, অশ্লীল ভাষায় গালি দেওয়া কখনও ভদ্রলোকের কাজ নয়–সেটা দেখতে বড়ই অশোভন। শ্বশুরের উপর বিরক্ত হবার কারণ হলে, তাদের বাড়ি না যেতে পারে। পত্নীর পিতা বা আত্মীয়স্বজনকে শ্রদ্ধা করতে যদি লজ্জা হয়, তবে বুঝতে হবে, তোমার পত্নী নির্বাচন ঠিক হয় নাই–সে বিবাহে খুব সম্ভব তোমার কখনও সুখ হবে না।
কতকগুলি লোকের স্বভাব এই যে, তারা আত্মীয়স্বজন দেখলে বিরক্ত হয়–তাদেরকে এড়িয়ে চলতে পারলে ছাড়ে না। জীবনে যদি অতিথি-কুটুম্ব দেখে ঘরে দরজা দিতে হয়। তার চাইতে মরণ ভালো। এটা বিলাত নয়, এদেশের নিয়ম, মানুষ মানুষের বাড়ী যায়। আত্মীয়তা করে। অবশ্য নিতান্ত আত্মীয় না হলে কারো বাড়ি যেয়ে কষ্ট না দেওয়া ভালো, কিন্তু নিতান্ত আপনার জনকে আদর-যত্ন করতেই হবে।
১ম বন্ধু–আত্মীয়-স্বজনকে কীভাবে আদর-যত্ন করতে হবে?
২য় বন্ধু–নিজের অবস্থা অনুযায়ী আত্মীয়স্বজনকে আদর করতে হবে। ক্ষমতার অতিরিক্ত করে কুটুম্বকে ভক্তি জানাবার দরকার নেই। পরম আত্মীয় যারা, তারা খাবার দাবার আয়োজনের চাইতে অনাত্মীয়ের সঙ্গসুখ ভালবাসেন। অতিরিক্ত কষ্টস্বীকার ভদ্রতা ও সৌজন্যের ফল পরস্পরের প্রতি বিরক্তি। ক্ষমতাশালী শ্বশুর বা কোনো বিশিষ্ট আত্মীয় যারা কৃচিৎ আসেন তাদের প্রতি একটু বেশি রকম শ্রদ্ধা দেখানোই উচিত। কিন্তু ক্ষমতার অতিরিক্ত কোনো কিছু করা প্রয়োজন নাই।
১ম বন্ধু–জামাই-এর আত্মীয়-স্বজনকে কন্যাপক্ষকে কিরূপ খাতির তোয়াজ করা উচিত? শুনেছি এক বাড়িতে জামাতার বাবা এলেন, দাবি দিয়ে তাকে আনা দুই পয়সা দিতে বলা হলো, কিন্তু কিনে খান গিয়ে, বাড়ীর কোনো লোক এসে তার সংবর্ধনা করলেন না। বুড়া বেগতিক দেখে ছেলেকে দোয়া করতে বাড়ি এলেন।
২য় বন্ধু–কলকাতায় এরূপ গল্প শুনতে পাই বটে, তবে এসব অতি কৃচিৎ ঘটে। পাশ্চাত্যসভ্যতার নামে কোনো কোনো যুবক অতিমাত্রায় অসভ্য হয়ে ওঠে–এ যে ইংরেজি শিক্ষার ফল–তা নয়। শিক্ষার নামে তারা কোনো কোনো সময় অজ্ঞাতসারে বড় অসভ্য হয়ে ওঠে–ইংরেজ জাতি পত্নীকে অতিশয় সমাদর করেন–পত্নীর বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করলে তারা অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠেন–কিন্তু একথা ঠিক যে, বিলাতি মেয়েরা ধর্ম জলাঞ্জলি দিয়ে কখনও কর্তব্যভ্রষ্টা হন না। কোনো কোনো শ্বশুরের ধারণা উচ্চশিক্ষিত জামাতা পত্নীকে নয়নতারা মনে করেন, জগৎ ত্যাগ করেন, পত্নীকে ত্যাগ করেন না–এই সাহসে তার, এমন কি জামাতার পিতাকে পর্যন্ত অপমান করেন। মূর্খ অসভ্য ছেলেরা বাস্তবিক পরী-প্রেমে নিজের আত্মীয়স্বজনের অপমান অকাতরে সহ্য করে-এ বড় লজ্জার কথা। পত্নী অতিশয় ভালোবাসা দোষের নয়। কিন্তু পত্নীর ভালবাসায় নিজের পিতামাতা, আত্মীয়স্বজনের অপমান সহ্য করা কাপুরুষের কাজ। এরূপ-শ্বশুর-শাশুড়ীর সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ না রাখাই উচিত।
.
আত্মীয়তা-লৌকিকতা
২য় বন্ধু–বন্ধু, আজ আত্মীয়তা সম্বন্ধে কিছু বলতে চাই।
১ম বন্ধু–হ্যাঁ বল। এখন কোনো বাধাবিঘ্ন নাই, এ ঘরের রাজা আমরা।
২য় বন্ধু–ভালো, পত্নীর কাছে কোনো চিঠিপত্র লিখেছ?
১ম বন্ধু–না, কোনো ইচ্ছাও নাই।
২য় বন্ধু–সে কী কথা! খোকা কেমন আছে–তারা কেমন আছে, এসব জানা দরকার।
১ম বন্ধু–আমি কেমন থাকি, সে কথা কি সে জিজ্ঞাসা করে?
২য় বন্ধু–নারী পরাধীনা, দুর্বল দাসী। যে স্বাধীন, বন্ধু প্রিয়তম এবং মুরুব্বী সেই কুশল জিজ্ঞাসা করতে পারে, জান না, গোলাম সালাম করতেও ভাবে-এতেও বুঝি প্রভু রাগবেন। জান না, পরমুখাপেক্ষী দাসের অবস্থা কী ভয়ানক। নারী তো দাসী–সে আবার -তোমার কী কুশল জিজ্ঞাসা করবে?
১ম বন্ধু–কালই পত্র লিখব।
২য় বন্ধু–হ্যাঁ লিখে দাও–খোকা কেমন আছে? আশ্বিন মাসে তুমি তাকে আনতে যাবে।
১ম বন্ধু–ওসব ঝঞ্ঝাট দিয়ে আর কী প্রয়োজন?
২য় বন্ধু–বিবাহ করেছ, কিন্তু দাম্পত্য ধর্ম কী তা জান না!
১ম বন্ধু–আচ্ছা কালই লিখব। এখন তোমার কথা বল।
২য় বন্ধু–আত্মীয়তা জিনিসটা করাই চাইহিংসা, ক্রোধ, কিংবা খরচের ভয়ে চোখ কান খুঁজে থাকা ভদ্রলোকের শোভা পায় না-ভগ্নিকে বিয়ে দিয়ে বনবাসে দেওয়ার মতো তার কোনো খোঁজ না রাখা, বড় অন্যায়। কোনো কোনো পিতা থাকেন–মনে করলাম, ও মেয়ে মেরে গেছে-বাঁকা হয়ে থাক। এও বড় খারাপ কাজ। কোনো কারণে মেয়ের বাড়ী যাবার কোনো বাধা থাকলে, অন্ততঃ পুত্রদিগকে হামেশা মেয়ের খোঁজ নেবার জন্যে অনুরোধ করা নিতান্ত দরকার। মেয়েকে পুনঃপুনঃ নিজের বাড়িতে আনবার জন্যে পীড়াপীড়ি করা ভালো না–কিন্তু তার সংবাদ গ্রহণ করতেই হবে। নিতান্ত দরিদ্র হলেও জিনিসপত্র উপহার জামাতার বাড়ীতে পাঠাতে ত্রুটি করতে নেই। কিন্তু ক্ষমতার অতিরিক্ত কিছুই করো না। জামাইকে খাতির করা, তাকে সঙ্গতি অনুসারে উপহার দেওয়া উত্তম।