হালিমা : চন্দ্রকরোজ্জ্বল নৈশ গগনের নিচে জীবনের বন্ধুকে নিয়ে প্রাণভরা হাস্যময়ী বৃক্ষ পল্লবীর মাঝখানে নিশি কাটিয়ে দেওয়া কী সুন্দর, কী স্বর্গীয়!
কুলসুম : সত্যি! কেবল পবিত্রতা ও প্রেমের মঙ্গল দৃশ্য! মরবার সময় প্রিয়ের বাহুর উপর মাথা রেখে এমন স্থানেই মরা উচিত।
হালিমা : সংসারের সব কাপড়গুলিই কি বোপর বাড়ি দিতে হবে?
কুলসুম : সব কাপড় ধোপার বাড়ি পাঠান অনেক পরিবারের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। ধোপর বাড়ি দিতে পারলে ভালোই হয়। কারণ নিজেরা কাপড় ধুলে দুই-এক দিনেই ময়লা হয়ে যায়। প্রতি সাত দিনে বিশ-কুড়িখানা কাপড় বাড়িতে ধোয়া কঠিন। প্রতি ১৫ দিনে ধোপাকে কাপড় দেবে। পরবার কাপড় ছয়খানা, কি আটখানা থাকা চাই। তা হলে আর নোংরা কাপড়ে বের হতে হবে না। নোংরা বিছানা, বালিশের ওয়াড় সর্বতোভাবে পরিত্যাজ্য। সর্বদা পরিচ্ছন্ন থাকা চাই। যাদের দুই একখানা কাপড় বেশি নাই তারা সেগুলি বাড়িতে ধুয়ে নেবেন। দুই-একখানা কাপড় থাকা লজ্জার বিষয় নয়–লজ্জা অপরিষ্কার থাকায়। বিনা চাঁদরে বিছানা এবং বিনা ওয়াড়ে বালিশ ব্যবহার করবে না।
হালিমা : ধোয়া কাপড়-চোপড় পরলে মনে অহঙ্কার আসে কি?
কুলসুম : ছিঃ, কেন অহঙ্কার আসবে? পরিষ্কার থাকা দরকার তাই পরিষ্কার থাকা। মনে অহঙ্কার আসা বড় লজ্জার কথা। যাদের পরিষ্কার থাকার অভ্যাস হয়েছে, তারা যে অপরিষ্কার বা নোংরা কাপড় পরা কোনো লোককে দেখে ঘৃণা কাবে–সেটাও অন্যায়। অনেক জ্ঞানী ভদ্রলোক আছেন, যারা ময়লা নোংরা কাপড়ে থাকেন, অবশ্য অনেক জ্ঞানী লোক নোংরা কাপড়ে থাকেন বলে সেটাকে গুণ বলে স্বীকার করে নিতে হবে না।
হালিমা : পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকাই দরকার বটে; ছোট ছেলেপেলেকে পরিষ্কার রাখা কিন্তু অসম্ভব।
কুলসুম : ছেলেপেলেরা ধূলামাটির মধ্যে মানুষ হয়ে উঠে সেই ভালো। ছোটকাল তাদের মন বেশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে গেলে হয়তো ভবিষ্যতে খারাপ হতে পারে। তবে মাঝে মাঝে অর্থাৎ প্রতি সাত দিনে তাদের গা পরিষ্কার করে দেওয়া উচিত।
হালিমা : রান্নাঘরেই কাপড় ময়লা হয় বেশি। —
কুলসুম : কেন? রান্নাঘরে সব সময়ে কাঁধের উপর একখানা করে গামছা রাখবে। কখনও পরনের কাপড়ে হাত মুছবে না। অনেক মেয়ে ও বধূর কাপড়ে হাত মোছার অভ্যাস আছে। এ একটা খারাপ অভ্যাস।
হালিমা : আমি দেখেছি, অনেক পরিবার প্রায়ই জিনিসপত্র, কাপড়-চোপড় হারায়। হারাবার অর্থ কোথায় থাকে কারো ঠিক থাকে না। খুঁজতে খুঁজতে বাড়ির সবসুদ্ধ লোক হয়রান হয়। অনেক পরিবারে এটা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। ওগো আমার কাপড় কোথায় গেল–আমার গামছা কী হল–আমার জ্যাকেট কে নিয়েছে–আমার জুতা কই ইত্যাকার হাঁকাহাঁকি, চীৎকার হরদম চলতে থাকে।
কুলসুম : এমন ধারা অমনোযোগী, বিশৃঙ্খল পরিবারে হয়ে থাকে। প্রত্যেকের কাপড়, জিনিস আলাদা জায়গায় থাকলে আর বিড়ম্বনা না। বোপা কাপড় দিয়ে গেলে যার যার কাপড় তার তার কাছে থাকবে। একখানা রুমালের জন্য চব্বিশ গণ্ডা বাক্স হাতড়িয়ে বেড়ান বাড়িসুদ্ধ লোকের পক্ষে বিরক্তিকর। যে জিনিস যেখানে থাকা দরকার সেই জিনিস ঠিক সেই জায়গায় রাখতে হবে। পরিবারের মধ্যে যদি সেয়ানা কারো ঠিক জায়গায় জিনিসপত্র রাখবার অভ্যাস না থাকে, তবে তার সঙ্গে ঝগড়া-ফ্যাসাদ না করে তার কাজটি নিজেই করে দেবে। প্রত্যেকের জন্য স্বতন্ত্র গামছা থাকা উচিত। বাড়ির প্রত্যেকের জিনিস নির্দিষ্ট স্থানের একটু এদিক-ওদিক যাতে না থাকে, সেদিকে গৃহিণীর বিশেষ দৃষ্টি আবশ্যক।
হালিমা : থালা, বাটি এ সব নিত্য পরিষ্কার করা বড় জ্বালা, অথচ না পরিষ্কার করলেও ব্যবহার করা যায় না।
কুলসুম : নিত্য সকাল বেলা থালা, বাটি ছাই দিয়ে বেশ মাজতে হবে। চিনা মাটির বা কাঁচের বাসনপত্র বিশেষ মাজতে হয় না। ছেলেপেলে যে বাড়িতে আছে, সে বাড়িতে এ বিলাসিতার প্রশ্রয় দেওয়া চলে না। বিদেশী জিনিস দিয়া জিনিসের দ্ৰতা করা ও বিলাস প্রবৃত্তিকে প্রশ্রয় দেওয়ায় গৌরব নেই–বরং তাতে লজ্জাই বেশি। কোনো কোনো হতভাগা মনে করে, চিনামটির বাসন ব্যবহার করলে তাদের বংশ মর্যাদা বেড়ে যাবে। মনুষ্যত্ব, জ্ঞান ও মহত্ত্বই যে মানুষকে বড় করে-এ তারা জানে না। বিদেশী বণিকেরা দয়া করে তাদের বিবাহ মজলিশ ও মিলাদ মাহফিলের শোভাবর্ধন করে-লজ্জার কথা, ঘৃণার কথা। নিজেদের কোনো শক্তি নেই, পরের অনুগ্রহে তাদের মর্যাদা বাড়ে। থালা বাটি নিজে পারলে নিজেই মেজে যথাস্থানে গুছিয়ে রাখবে। যে দাসীরা ভিতরে ভিতরে বড় অপরিষ্কার, তাদের থালা বাটি মাজতে না দেওয়াই ভালো। উপায় না থাকলে তারাই মাজবে।
হালিমা : বড় পরিবারে রাশি রাশি থালা জোটে।
কুলসুম : বড় পরিবার হলে একজনের পক্ষে পরিবারের সকল কাজ সুচারুরূপে সম্পাদন করা খুব ভয়ানক কথা। এক পরিবারে অনেক লোক না থাকাই ভালো। এতে সমাজ দুর্বল হয়ে পড়ে। কতগুলি লোক অকারণে আলসে ও কুঁড়ে হয়। যার যার ভাবনা সেই সেই ভাববে, বিলেতে ছেলে বড় হলে তাকে পৃথক করে দেওয়া হয়। অনেক লোক এক সঙ্গে থাকলে বাড়ির বৃদ্ধ মাতা-পিতাকে বিপন্ন ও দুর্দশাগ্রস্ত হতে হয়।