.
সপ্তম পরিচ্ছেদ
অনেক দিন শহরে থাকিয়া হালিমা ভাবি ও চাচি সহ বাড়ি ফিরিয়া আসিয়াছিলেন।
একখানি পুস্তক লইয়া ছাদের উপর হালিমা পড়িতেছিলেন, কুলসুম শুনিতেছিল। হালিমা জিজ্ঞেস করিলেন–ভাবি বিয়ে জিনিসটা সুখের কিন্তু ছেলেপিলে হলে জীবনের ঝঞ্ঝাট খুব বেড়ে ওঠে।
কুলসুম : তা বেড়ে ওঠে বৈকি?
হালিমা : বেশি জ্বালা হয়, রাতদিন ঘ্যানঘ্যানানি, বাহ্যি আর প্রস্রাবে। শীতকালে শুয়ে আছে-লেপের ভিতর বেশ আরামে, সেখানেই খোকা পায়খানা করবেকী বিপদ? লেপ তোষক, বিছানা-চাঁদর সব বরবাদ হয়ে যায়।
কুলসুম : ছেলেকে সব সময় মাইয়ের দুধ না দিলে এই বিপদের হাত থেকে অনেকটা উদ্ধার পাওয়া যায়। বাইরের স্ত্রীলোকদের হাতে ছেলেকে ছেড়ে দেওয়া দোষ। সন্তানের জন্য স্বতন্ত্র বিছানা চাই। নিজের কছে শোয়াবে না। তিন তিনটি ভালো ‘ফিডিং’ বোতল কিনে রাখতে হয়, দুধ গরম করে নেবার জন্য একটা ছোট স্পিরিট ল্যাম্প রাখতে হয়। মোটা ছোট ছোট ৮/১০ খানা তোয়ালে রাখা উচিত। মাই-এর দুধ না দিলে বিশেষ ক্ষতি–দুধ না হলে অনেক মা গরুর দুধ দিয়ে থাকেন, তাতে খোকার অসুখ হয় না। ভার বিছানার উপর খোকাকে শোয়াবে না, দুই এক মিনিটের জন্য আদর করে শোয়ালে দোষ নেই। কাপড় না দিয়ে থোকা খুকিকে কোলে নিতে নেই। পেশাবে কাপড় পচে অল্প দিনেই ছিঁড়ে যায়। রাত্রিকালে শিয়রে দুধ, স্পিরিট ল্যাম্প, ফিডিং বোতল রেখে দিতে হয়। বোতলে দুধ পুরে নল শিশুর মুখের ভিতর ভরে দিলে মোটেই কাঁদে না কিংবা মাকে জ্বালাতন করে না। সারারাত্রি মায়ের কোলের জন্য খোকা কাঁদতে থাকলে প্রসূতির স্বাস্থ্য নষ্ট হয়। বিছানা, কাপড়-চোপড় নষ্ট হয়ে যায়। শুধু খোকাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলে চলবে na, গৃহিণীকে সব দিকে চাইতে হইবে। নিজের একটুখানি সুযুক্তি ও বন্দোবস্তের অভাবে অনেক সময় স্বামীকে সেবা-সুখ দিতে পারা যায় না, নিজের জীবনের কষ্টও বেড়ে ওঠে। ছেলের কোমরের সঙ্গে একটা মোটা লেঙ্গটের মতো আবরণ বেঁধে রাখবে, তাতে হঠাৎ কাপড় বা ঘর নষ্ট হবার সম্ভবনা থাকে না। ভাত রাঁধা বা রান্নাঘরের কাজের জন্য দাসী রাখার পক্ষপাতী আমি নই; শুধু ছেলে রাখার জন্য একটা মেয়ে চাকর রাখা হয়। এই মেয়ে চাকরটিকে বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকবার তাগিদ দিতে হবে। নিজে সাবান ব্যবহার কর বা না কর এই দাসীটি যেন প্রত্যহ স্নানের সময় সাবার ব্যবহার করে, সে যেন কখনও ময়লা কাপড় না পড়ে, তার কাপড় নিজের কাপড়ের সঙ্গে বোপর বাড়ি যাওয়া চাই। দাসী জুটলে নিজের কাজ নিজেকে করতে হবে–আলসেমি করে কখনও নোংরা থাকবে না।
হালিমা : বিছানাপত্র কিরূপ হওয়া চাই?
কুলসুম : ছোট ছোট ছেলেপিলের জন্য ভালো বিছানার দরকার নেই। কোনো দরিদ্র রমণীর দ্বারা মোটা কাথা সেলাই করে তাদের জন্য ব্যবহার করবে। আদর করে খোকাকে ফরাশে শোয়ালে পেশাবে ফরাশ পচে যায়; এই ধরনের আদর তাদের বিরক্তিকর। ছেলেপিলের বিছানা স্বতন্ত্র হবে স্বামীর জন্য যে বিছানা রচনা করবে তা যেন ছেলেপিলের বাহ্য প্রস্রাবে নোংরা না হয়। একটা তোষক, একখানা বিছানার চাঁদর ও একটা বালিশ এই-ই একটা শয্যার জন্য যথেষ্ট।
হালিমা : পরবার কাপড়-চোপড় কীরূপভাবে কোথায় রাখতে হবে? স্বামীর নিজের ও সকলের কাপড় এক জায়গায় রাখা উচিত, না আলদা আলাদা করে রাখা ভালো?
কুলসুম : প্রত্যেকের কাপড় আলাদা আলাদা করে রাখা উচিত। প্রত্যেকের জন্য স্বতন্ত্র ব্রাকেটের ব্যবস্থা না করতে পারলে দড়ি ঝুলিয়ে নেবে।
হালিমা : ছোট ছোট ছেলের জন্যও ভিন্ন ভিন্ন ব্রাকেটের দরকার? তাদের তো বেশি কাপড় থাকে না।
কুলসুম : বেশি কাপড় না থাকলেও শৃঙ্খলা ও সৌন্দর্য শিক্ষা দেবার জন্য তাদের আপন কাপড় নিজের মতো আলাদা আলাদা করে রাখতে বলবে। যেখানে সেখানে কাপড় চোপড় ফেলে রাখা তাদের একটা বদ অভ্যাস।
হালিমা : সত্যি তারা বড় জ্বালাতন করে। মামার ছেলেরা এখানে কয়দিনের জন্য এসেছিল, তাদের দৌরাত্মে অমারা অস্থির হয়ে পড়েছিলাম। মারামারি, শোরগোল, কাদাকাটি হরদম লেগেই ছিলো। প্রতি সন্ধ্যায় কে-কেথায় জুতো ফেলেছে ঠিক নেই–বাতি জ্বেলে সারা উঠান খুঁজে বেড়ান একটা নিত্য-নৈমিত্তিক কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। স্নানের সময় কোথায় কাপড় কোথায় গামছা ঘর বার তোলপাড় করে।
কুলসুম : পা না ধুয়ে বিছানার উপর লাফিয়ে উঠা তাদের আর একটা বদ অভ্যাস। বোকা মায়ের মতো ছেলেমেয়েকে কখনও প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক নয়।
হালিমা : ঘরের বারান্দায় ফুলের গাছ রাখা কেমন?
কুলসুম : ফুলের গাছ বারান্দায় রাখা ঠিখ নয়। দুই একটা ছোট গাছ রেখে দেওয়া যেতে পারে। ঘরের ধারে বা বারান্দায় জঙ্গল করে রাখলে মশার উপদ্রব বাড়তে পারে।
হালিমা : বাড়িতে ফুলের বাগান না থাকলে মন নিষ্ঠুর হয়ে উঠে।
কুলসুম : সে তো নিশ্চয়। প্রত্যেক বাড়ির সম্মুখে একটা স্বল্পবিস্তৃত ময়দান এবং একটি সজীব শ্যামল ফুল বাগান থাকা চাই। মনকে আধ্যাত্মিক ভাবাপন্ন করবার এক প্রকৃত পন্থা হচ্ছে–প্রকৃতির সবুজ গাছপালার সঙ্গে যোগ রাখা। যারা গাছপালার সৌন্দর্য উপভোগ করতে জানে না তাদের মন কঠিন হয়ে পড়ে। তাদের সংসারী দৃষ্টিহীন প্রাণে কোমলভাবের উদ্রেক হয় না।