বলেই বিশৃঙ্খলা দূর হবে না। কুড়ে আলসেরাও বেশি রকম বিশৃঙ্খল। বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের স্বভাব থেকে প্রথম হতেই এই দোষ দূর করে দিতে হয়। কাপড়-চোপড়, জুতা-জামা, রান্না ঘরে ফেলে ভাত খেতে বসা ছেলেদের অভ্যাস। এই বদ অভ্যাস দেখলেই বিরক্তি প্রকাশ করবে। যথস্থানে জিনিসপত্র রাখবার প্রবৃত্তি তাদের শিক্ষা দিতে সর্বদা সচেষ্ট হবে। ভবিষ্যৎ জীবনে তাদের জীবনের অনেক দুঃখ তাতে কমে আসবে।
হালিমা : ছেলের ভাবনা ভাববার ঢের দেরি।
কুলসুম : বিয়ের পর এক বছরেই ছেলে হতে পারে।
০৬-১০. আবদুল গণি শহরে
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
আবদুল গণি শহরে যে নূতন বাড়িটি প্রস্তুত করিয়াছেন তাহা তাঁহার অফিস ঘর ও শহরের সদর স্থল হইতে কিছু দূরে।
তিনতলা মাঝারি অবয়বের বাড়িটি, প্রাচীর বেষ্টিত। ঘরের সম্মুখে প্রাচীরের মধ্যেই নবীন শ্যামল দূর্বাচ্ছাদিত ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের মাঝখানে একটা পুকুরের চারিধারে লতাগুল্ম শোভিত ফুটপাথ। বহিঃদরজার পার্শ্বের ভিতরের দিকে একটি আলোক স্তম্ভ। সারারাত্রি সেখানে বাতি জ্বলে।
তখন ঊষা হইয়াছিল। লতা-পত্রের গায়ে গায়ে বিন্দু বিন্দু শিশির জমিয়াছিল। ঊষার স্নিগ্ধ বাতাস রহিয়া রহিয়া বহিতেছিল। দুইটি সুন্দ। যুবতী পুকুরের ধারে পদচারণা করিতেছিলন। বলা বাহুল্য বাড়ির ভিতর কাহারও প্রবেশ করিবার অধিকার ছিল না। প্রতিবেশী ছেলেমেয়ে বা বউ-ঝিদের আসার কোনো বাধা ছিল না।
লতা-পত্রের মাঝখানে হালিমা ও তাহার ভাবিকে বড় সুন্দর দেখাইতেছিল। পরীবালা বলিয়া ভ্রম হইতেছিল। তাহাদের অঙ্গ হইতে মাধুরীর স্নিগ্ধ জ্যোতি বিকীর্ণ হইতেছিল।
কিছুক্ষণ হাঁটিয়া তাহারা বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করিলেন। নিচের তলায় একখানা টেবিলের সম্মুখে আবদুল গণি বসিয়া সংবাদপত্র পাঠ করিতেছিলেন। হালিমা ও কুলসুম পার্শ্ব দিয়া উপরে উঠিয়া গেলেন।
আবদুল গণি ও হালিমার মাতা কোরান পাঠ করিতেছিলেন। হালিমা ও কুলসুম প্রবেশ করিলে তাহারা কোরান পাঠ বন্ধ করিলেন। হালিমার মাতা রহিমা জিজ্ঞেস করিলেন, কোথায় গিয়েছিলে মা?
কুলসুম কহিলেন-পুকুর পাড়ের বাতাস সকাল বেলায় মধুর লাগে। রহিমা হাফিজাকে কহিলেন-বু, বিকেল বেলা পুকুরে আমরা ছিপ দিয়া মাছ ধরবো।
হাফিজা আবদুল গণির মায়ের নাম। হালিমার দিকে ফিরিয়া কহিলেন–হালিমা, তুই তোর ভাবির সঙ্গে চা তৈরি কর।
কুলসুম শাশুড়ীকে জিজ্ঞেস করিলেন–ক’টি হুইল আছে?
রহিমা বলিলেন-তোমরা দুটো নেবে, আমরা দুই জা দুটো নেবো! ঠিক ঠিক চারটি হুইলই আছে।
হাফিজা কহিলেন : চারের মসলা আছে তো?
কুলসুম : না, তা তো নেই।
আবদুল গণি আসিয়া ঘরে প্রবেশ করিলেন। হালিমা যেমন ছিলেন তেমনি দাঁড়াইয়া রহিলেন।
আবদুল গণি কহিলেন–মসলার জন্য এখনই লোক পাঠাচ্ছি।
দুপুর ভরিয়া হালিমা ও কুলসুম চার প্রস্তুত করিলেন। শেষ বেলায় সূর্যকর যখন স্নান হইয়া আসিল, তখন হাফিজা, রহিমা, কুলসুম ও হালিমা ছোট পুকুরটির ধারে হুইল হাতে বসিলেন।
পুকুরের পশ্চিম ধারে বসিলে হাফিজা ও রহিমা।
অর্ধ ঘণ্টার মধ্যে একটা মাছও ধরিল না। হালিমা বিরক্ত হইয়াছাই, একটা মাছও পুকুরে ধরছে না। মাছ নেই। তখন হলিমার মা হুইল আকর্ষণ করিলেন।
একটা ছোট এক হাত রুই ঘাটের উপড় পড়িয়া লাফাইতে লাগিল।
উৎসাহে হালিমা ও কুলসুম হুইল ফেলিয়া পশ্চিম ঘাটে আসিলেন। আবদুল গণি ঘরের মধ্যে বসিয়া ব্যবসায়ের খাতা পত্র দেখিতেছিলেন। মাছ ধরা পড়িয়াছে জানিয়া তিনিও হাসিতে হাসিতে বাহিরে আসিলেন। হালিমা, কুলসুম, আবদুল গণি, রহিমা ও হাফিজা এক জায়গায় বসিয়া আনন্দ প্রকাশ করিতে লাগিলেন। এইখানেই মাছ ধরা শেষ হইল।
আবদুল গণি হুইলগুলি গুটাইয়া ঘরে রাখিয়া আসিলেন।
সেদিন রাত্রিকালে আহারের খুব ঘটা হইল। কোর্মা, পোলাও, মাছ, দই, ফিনী, হালুয়া, পারাটা, ভাজি, ডাল প্রভৃতি নানাবিধ রসনাতৃপ্তিকর খাদ্যের বন্দোবস্ত হইল। পাচিকা কুলসুম ও হালিমা। আবদুল গণি রান্না ভালো হইয়াছে বলিয়া ভাবি সাহেবাকে প্রশংসা করিলেন। কুলসুম কহিলেন-রান্নার জন্য হলিমাকেই তারীফ করা উচিত, কারণ হালিমাই রাঁধিয়াছেন, আমি কেবল একটু যোগাড় দিয়াছি মাত্র।
আবদুল গণি কহিলেন–হালিমা বেশ রাঁধতে পারে। আমি এটা জানতাম না। হালিমা গম্ভীর মুখে প্রশংসা গ্রহণ করিল।
রহিমা, হাফিজা, আবদুল গণি একস্থানে আহার করিতেছিলেন। হালিমার হাতের প্রস্তুত সুন্দর একখানি দস্তরখানের উপর তাহারা খাইতেছিলেন।
সেখানে কোনো কাঁচ বা চীনা মাটির বাসন ছিল না। সুন্দর দামী পরিপাটীরূপে নির্মিত কাঁসার শক্ত গ্লাস বরতনেই দস্তরখানের শোভাবর্ধন করিতেছিল। যে সব দ্রব্য নিজের দেশে প্রস্তুত হয় না, সে সব জিনিস আবদুল গণি ব্যবহার করেন না। তিনি বলেন, এতে জাতির অগৌরব কালির রঙ্গে ফুটে উঠে। পরের দেওয়া দানে ভদ্র সাজতে যাওয়া কাপুরুষের পক্ষেই সম্ভব।
আবদুল গনি পানি চাহিলেন।
হলিমা সোরাই হইতে কেওড়া দেওয়া পানি গ্লাসে ঢালিয়া আবদুল গণির হাতে দিলেন।
কুলসুম তাহার শাশুড়ীদ্বয়কে—’আর একটু দেই–আর একখানা গোস্ত-একটু চাটনী দেই’ বলিয়া বালিয়া হয়রান করিতেছিলেন। রহিমা ও হাফিজা সমস্বরে কহিতেছিলেন-না মা, আর কাজ নেই, তুমি আমাদেরকে মেরে ফেলবে দেখছি।