কুলসুম বলিলেন–অনেক সময় ঘরে চিনি মিছরির গন্ধে পিঁপড়ে ওঠে। মিছরির পাত্রের সঙ্গে কর্পূর দিলে পিঁপড়ে আসে না।
.
এয়োবিংশ পরিচ্ছেদ
কুলসুম বলিলেন–প্রিয় হালিমা, তোমার বিয়ের দিন চলে এসেছে, আমার কথা বলা শেষ হয়েছে। আর কয়েকটি কথা বলেই আমি শেষ করব।
বাড়িতে কেউ মরলে মাথা ভাঙ্গাভাঙ্গি করে কেঁদো না। আঁখিজল নির্জনে ফেলবে। লোকে যেন না দেখে। মরণে খুব বেশি দুঃখ করা গোনাহ। মরণকে উপহাস করতে হবে। এ জগৎকে প্রাণের সঙ্গে মিথ্যা মনে করা বা কর্তব্য সম্পাদনে জগৎকে মিথ্যা মনে করা উচিত নয়।
আরও শোন–দেখ অনেক সময় বন্ধুর জন্যে পরিবারে অশান্তির সৃষ্টি হয়। স্বামী ও শ্বশুর শাশুড়ীর মধ্যে মনোমালিন্য আরম্ভ হয়। অভাব, মূর্খতা ও অনুন্নত মনই এইসব মনোমালিন্যের কারণ। অনেক সময় অনেক মাতা সন্দেহ করেন, বিবাহের পর তার স্থান ছোট হয়ে গেল। পুত্র আর তেমনি করে মাতাকে ভালবাসে না। এই সন্দেহ বড়ই মারাত্মক। শাশুড়ীর উপর খুব শ্রদ্ধা রাখবে; স্বামীকে খাওয়াবার আগে সর্বদা শ্বশুর শাশুড়ীকে খাওয়াবে। উপহার ও অর্থ দিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ীকে নিজেদের ভালবাসা ও বশ্যতা জানাবে।
শ্বশুরবাড়িতে বধূর সম্মান না হলে অনেক সময় বধূরা স্বামীর কাছে তার শ্বশুর শাশুড়ীকে খেলো করতে চেষ্টা করেন। নিজের সম্মান না হলেও স্বামীর কাছে কোনো কথা
বলাই শ্রেয়। নারীর দুঃখের শেষ নেই। স্নেহ, মমতা, প্রীতি, অনুরোধের আদান-প্রদানই পরিবারের শান্তির কারণ। একজন অন্যজনের দোষকে সর্বদা ক্ষমা করবে, প্রত্যেকে প্রত্যেকের ভাবের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করবে, কেউ কারোর উপর অত্যাচার করবে না, তাহলেই পরিবারের মঙ্গল হয়। সুখ, শান্তি ও উন্নতি বাড়ে।
কুলসুম আবার বলিলেন-দেখ, ইংরেজি শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নবীন যুব সমাজ ও পুরাতন বৃদ্ধ সমাজের ভিতর একটা দ্বন্দ্ব বেঁধে উঠেছে। প্রাচীনেরা যা ভাবেন, নবীনেরা তার উল্টা কথা বলেন। নবীনের চিন্তা সম্পূর্ণ নতুন রকমের; জীবন ও সমাজ সম্বন্ধে তার যে ধারণা তা শূন্যে প্রাচীন উপহাস ও অবজ্ঞা করেন, ফলে বহু পিতা-পুত্রে মনোমালিন্য হয়। বহু পরিবারে অশান্তির আগুন জ্বলে ওঠে। ওর মীমাংসা কী তা বলা কঠিন। উভয়ে উভয়ের উপর খড়গহস্ত না হয়ে, প্রত্যেক প্রত্যেকের কথা সম্বন্ধে ভেবে দেখা উচিত। একে অন্যকে বুঝতে চেষ্টা করতে চাই। তাহলেই বোধ হয় একটা মীমাংসা হতে পারে। প্রাচীনেরা যদি নবীনের কাছে কিছু শেখার থাকে তাতে প্রাচীনেরই গৌরব, তাতে প্রাচীনের লজ্জার কারণ নেই, কারণ প্রাচীনের বুক ভেঙ্গে নবীন বের হয়।
নিজের বা পরিবারের আকস্মিক কোনো বিপদ হলে যে-কোনো ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেটের সঙ্গে দেখা করা যায়, এ কথা জেনে রাখা উচিত। চুপ করে থাকা নিষেধ। আইন একটা নূতন জিনিস নয়। বুদ্ধিই শ্রেষ্ঠ আইন। সাধারণ বুদ্ধি নিয়ে লোকের সঙ্গে কথা বললেই জয় হবে।
আর একটি কথা, বাড়ি যাতে দেখতে সুন্দর হয় তা দেখবে, কতকগুলি ঘর হিজিবিজি করে তুলে রাখা ঠিক নয়। বাড়িগুলি সর্বদা চতুষ্কোণ আকার হবে। সামনে ফুলের বাগান থাকবে, শ্যামপুষ্পচ্ছাদিত একটা ছোট ক্ষেত থাকাও নিতান্ত উচিত।
বাড়িতে ধান মাড়াবার জন্য একটা স্বতন্ত্র স্থান পাকা করে বাধিয়ে নেওয়া ভালো। বাড়ির ভিতরকার উঠোনে খানিকটা স্থান ইট দিয়ে বাঁধিয়ে নিয়ে সেখানে ধান শুকান যেতে পারে।
সংসারে অনেক বিপদ ও কষ্টের কারণ এসে জোটে, সে সমস্ত কথা চিন্তা করে শরীর নষ্ট করা ভুল।
মেয়ে বিয়ে দিলে জামাই বা বৈবাহিক যখনই মেয়ে নিতে আসেন তখনই তাকে যেতে দেবে। মেয়ে না দিয়ে কখনও অভদ্রতার পরিচয় দিও না।
পাড়া-প্রতিবেশীর বাড়িতে কুটম্ব বা শিক্ষিত ভদ্রলোক এলে তাকে দাওয়াত করে খাওয়ান ভালো। অবস্থায় না কুলোলে দরকার নেই। দুধ, দই বা ক্ষীর খাবার থাকলে অতিথি বা যে কেউ হোক আগেই সামনে দিতে হয়। খাওয়া শেষ হয়ে গেলে সেসব হাজির করাই উচিত।
শ্বশুর-শাশুড়ী বুড়ো হয়ে গিয়েছেন বলে কখনও মনে করো না–তাদের খাবার পরবার কোনো ইচ্ছা নাই, তারা কেবল মৃত্যুর কথা ভাবেন, এ কথা ভেবো না। বধূর হাতে প্রাণ ভরে খাবেন বলে অনেক শ্বশুর-শ্বাশুড়ী জীবন ভরে আশা করে থাকেন, সুতরাং তাদের খাবারের প্রতি বিশেষ নজর চাই। শ্বশুর-শাশুড়ীর জন্য স্বামীকে বিদেশ থেকে মাঝে মাঝে নানাপ্রকার ফলমুল, বিস্কুট, হালুয়া, ও কেক আনতে বলবে। অল্প হলেও তাদের নানা সুস্বাদু জিনিস খাওয়াবে–এতে তারা কত সুখী যে হন, তা ভাষায় প্রকাশ করে বলা যায় না। খাবার সময় কখনও ছেলেপেলেকে তাঁদের কাছে যেতে দেবে না।
স্বামীকে বলল, যেখানে বাধা দেওয়া দরকার সেখানে যেন তিনি বাধা দেন, যেখানে ঘাড় শক্ত করা দরকার, সেখানে যেন তিনি কাপুরুষের মতো ঘাড় নরম না করেন। বাধা
দিলেই মৃত্যু হয়, ঘাড় নরম করলেই বেশি করে অসম্মান হয়। তাই বলে একগুঁয়েমি ভালো নয়।
নারী চরিত্রে একগুঁয়েমি ভাবটা অনেক সময় বড় প্রবল। সংসারের যত রকম খরচই। হোক না, কখনও বাজার খরচের টাকা কাউকে দেবে না। কেউ মাথায় লাঠি মারলেও এ টাকা ঘর থেকে বের করতে নেই। বাজার খরচ ভেঙ্গে ঋণ পরিশোধও নিষেধ। সোজা। বলে দিও, না খেয়ে মরতে পারি নে।