আবার কহিলেন–অমুক ছোট লোকের মেয়ে বা ছেলে, এ কথা বলা পাপ ও অনৈসলামিক। যেখানে জ্ঞান ও চরিত্র সেখানেই সম্বন্ধ করবে। পণ্ডিত ব্যক্তিকে ছোট লোক বলা পাপ-হউক তার আত্মীয়-স্বজন ছোট, বিয়ের পর মেয়ের স্বামীকে সর্বদা আদর-যত্ন করা উচিত। জামায়ের সেবার কোনোরূপ অসুবিধা যেন না হয়।
কুলসুম আবার বলিলেন, ছেলে যদি দূর দেশে যেতে চায়, আঁখিজলে বুক ভাসিও না। মায়ের অঞ্চলের নিধি হয়ে বাড়িতে থেকে চিরকাল দুঃখ, অসম্মান ও দারিদ্র্য-জ্বালা সহ্য করা মূখের কাজ। ছেলেকে প্রয়োজন হলে মিশর, জাপান, চীন, রাশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকাতে পাঠাতে চেষ্টা করবে। এতে ভয়ের কোনো কারণ নেই।
ছেলে বিদেশী ভাষায় পরীক্ষায় ফেল করলে কাদাকাদি করা ভালো নয়। পাসের জন্য রোজা রাখা, সিন্নি মানত করা মূর্খতা। একবার ফেল করেছে তাতে কি ক্ষতি, পরের বারে সে সফল হবে। কোনো বিশেষ বিষয়ে ছেলেমেয়ে যদি কাঁচা থাকে, তবে সেজন্য প্রাইভেট শিক্ষক রাখবে। পাস না করেও চেষ্টা করলে ছেলেমেয়ে শ্রেষ্ঠ ও বড় লোক হতে পারে। পরীক্ষায় ফেল করলে তার জীবন মাটি হয়ে গেল, এমন কোনো কথা নয়। তাকে চরিত্রবান জ্ঞানী করতে পারলেই যথেষ্ট, আর কিছুই দরকার নেই।
ছেলেমেয়েকে খুব বাল্যকাল হতেই বাপকে শ্রদ্ধা করতে শেখাবে–তুমি যেমন শেখাবে তেমনি সে শিখবে। বড় হলে তাদের নতুন করে কিছু শেখান যায় না। ছেলেমেয়েকে মাঝে মাঝে পায়খানায় নিজের জন্য পানি দিয়ে আসতে বলবে। শীতকালে সকাল বেলা পানি গরম করতে বলবে। মিষ্টি কথায় মধুর ব্যবহারে পুত্র কন্যাকে বাল্যকাল হতেই সেবাকার্য শিক্ষা দেবে-বৃদ্ধকালে, বিপদকালে হাসিমুখে পূর্বের অভ্যাস মতো তারা তোমাদের সেবা করবে। তাতে তাদের কোনো কষ্ট হবে না। হাসিমুখে প্রিয়তম বাপ-মাকে তারা সেবা করবে।
ছোট ছেলেপেলেকে উপুড় হয়ে শুতে দেখলে নিষেধ করবে। বলবে উপুড় হয়ে শোওয়া দোষ, আর কিছু না। মাঝে মাঝে বাড়ির ছেলেমেয়েদের হাতে ২/১টি পয়সা কিছু কিনে খাবার জন্যে দেবে। শুধু ছেলেমেয়ে নয়, চাকর-দাসীকেও মাঝে মাঝে কিছু দেওয়া উচিত। পয়সা নেই এ কথা বলো না।
বিয়ের পর ছেলেমেয়েকে স্বাস্থ্য সম্বন্ধে কোনো অশ্লীল উপদেশ দিও না।
.
দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ
কুলসুম বলিলেন-সংসার করতে হলে, ছেলেমেয়ে, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে বাস করতে গেলে আরও কতকগুলি বিশেষ দরকারি কথা তোমাকে জানতে হবে।
হালিমা কহিলেন-বলুন ভাবি।
কুলসুম : ঘরের মেঝে ভিজে হওয়া বড় দোষের, এরূপ হলে শরীর নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। আর্দ্র মেঝেতে শুকনো মাটি বা বালি ছড়িয়ে দিয়ে উপরে চাটাই বা মাদুর পেতে দিতে হয়।
মাঝে মাঝে বর্ষাকালে অনেক ছেলেমেয়ে পানিতে ডোবে। আমার মনে হয়, অনেক স্থানে তাজা সন্তানকে মরা মনে করে লোকে দাফন করে।
হালিমা কহিলেন–কি ভয়ানক কথা।
কুলসুম : ভয়ানকই বটে।
হালিমা : মানুষ মরলে চেনাই যায়, এতে আর ভুল হবার কি আছে?
কুলসুম : মানুষকে অনেক সময় মরা বলে ভ্রম হয়। কিন্তু আসলে তারা মরে না। আচ্ছা বল দেখি, কেমন করে মানুষ মরেছে বোঝা যায়?
হালিমা : নিশ্বাস যখন চলে না, হাত-পাগুলি যখন শক্ত হয়ে যায়, দৃষ্টি স্থির তখনই জানা যায় মানুষ মরেছে।
কুলসুম : তোমার ধারণা ভুল। অনেক সময় দেহে প্রাণ থাকা সত্ত্বেও মানুষের এই অবস্থা হয়। মরা মানুষ পুনরায় বাঁচবার কাহিনী অনেক শোনা যায়। নিশীর রাত্রে গোরস্থানে বা নদীর ঘাটে অনেক মরা মানুষ আবার বেঁচে ওঠে। অশিক্ষিত গ্রাম্য লোকেরা ভূত মনে করে প্রাণভয়ে পালায়। এইসব খোদার অনুগ্রহপ্রাপ্ত পুনরুজ্জীবিত মানুষের মাথায় কত লাঞ্ছনা ও অত্যাচারের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়।
হালিমা : কী করে ঠিক বোঝা যায় যে মানুষ মরেছে?
কুলসুম : কয়েকটি ভালো পরীক্ষা আছে। একটি ২ চ্ছ আগুনেও মৃতদেহ ফোস্কা হয় না। কোনো কোনো তথাকথিত মৃতদেহ ৭/৮ দিন পর্যন্ত প্রাণ থাকে। আহা খোদার কি মহিমা!
হালিমা : পানিতে ছেলে ডুবলে কি করতে হবে?
কুলসুম : চৈতন্যহীন শিশুর চৈতন্য আনা যায় কিনা, তার চেষ্টা করতে হবে। চিৎ করে শোয়াবে। পিঠের নিচে একটা বালিশ দিয়ে বুকটা মাথা হতে কিছু উঁচুতে রাখবে তার পর মাথার দিকে বসে শিশুর হাত দুখানি কনুইয়ের উপর ধরে লম্বা করে একসঙ্গে মাথার দিকে নিয়ে আসবে, তারপর আবার বুকের দিকে নিয়ে হাত দু’খানি ভঁজ করে বুকের পার্শ্বে লাগাবে। এইরূপ ঘন্টা ধরে করবে, আর এক কথা–ঐ সঙ্গে মুখের ভিতর থেকে জিভ বের করে টেনে ধরে রাখতে হয়, এইরূপ করলে শীঘ্র শ্বাসক্রিয়া হবার সম্ভাবনা। পঁচিশ মিনিটের বেশি পানিতে থাকলে কোনো আশা নাই।
বাড়ির কাউকেও সাপ কামড়াইলে দংষ্ট্র স্থানের উপরে অবিলম্বে ২/৩টি বাঁধ দিতে হয়। হালিমা শিহরিয়া উঠিয়া কহিল–ভাবি আমার বড় ভয় হচ্ছে, ওকথা আমি শুনতে চাই নে।
কুলসুম : না শুনলে চলবে না। সংসারে বাঁচতে হলে আমাদের নিরন্তর সতর্ক থাকতে হবে।
হালিমা : তা তো ঠিক।
কুলসুম : সাপে আমাদের দেশে দরিদ্র লোককেই বেশি কামড়ায়। বাড়ির চারদিক সর্বদা সাফ রাখতে হয়–এদিকে প্রত্যেক গৃহস্থের বিশেষ মনোযোগ চাই। বাড়ির ধারে . জঙ্গল বড়ই আপত্তিজনক।
রাস্তায় যখন আলোক জ্বলে এইরূপ করে বাড়িতে সারারাত্রি না হোক, ১০/১১টা পর্যন্ত বড় বাতি জ্বালানো উচিত, যাতে বাড়িখানি আলোকময় হয়ে ওঠে। বাড়ির রাস্তাগুলি ইটের কুচি দিয়ে বাঁধিয়ে নেওয়া উচিত। ঘরের পার্শ্বে বহু শিকরবিশিষ্ট গাছ থাকাও অন্যায়। ঘরের মেঝে অবস্থায় কুলোলে ইট ও সিমেন্ট দিয়ে বাঁধিয়ে নেওয়া উচিত। যাক, যা বলছিলাম–সাপে কামড়ালে বাঁধ দিয়ে দংষ্ট্র স্থানের মাংস ছুরি দিয়ে কেটে ফেলবে, তারপর গরম পানি দিয়ে ক্ষতস্থান ধুয়ে, সেখানে পটাশ-পারম্যাঙ্গানেট লাগিয়ে দেবে। এ ওষুধ শহরে বা মহকুমার ডাক্তারদের কাছে পাওয়া যায়। সাপে কামড়িয়েছে কিনা সন্দেহ হলে মরিচ খেতে দেওয়া উচিত। সাপ কামড়ালে মরিচের তীব্রতা জিভে লাগে না।