মেয়েদের মাঝে মাঝে বৈঠক করে সভাসমিতি করতে এবং বক্তৃতা দিতে উৎসাহ দিও। হায়দ্রাবাদে মেয়েরা দোকান দেয়, বেড়াতে বের হয়। স্যার সৈয়দ আমীর আলী তাঁর ইতিহাসে লিখেছেন, ইসলামের প্রথম যুগের আরব মহিলারা কোনো বোরকা ব্যবহার করতেন না, মেয়েরা গান গাইতেন, তাতে কোনো দোষ হতো না। খলিফা ওমর রাস্তায় থেকে অনেকে সময় সেই গান শুনতেন।
ছেলেমেয়েরা বড় ভাই বা বোনকে বা মুরুব্বীদের বাঘের মতো ভয় করুক–এটা ভালো নয়। সন্তানের সুবুদ্ধি ও বিবেক জাগাতে চেষ্টা করবে। সে যেন তার বিবেককে বেশি ভয় করে।
ছেলেমেয়েরা যেন ব্যক্তিত্বহীন একটা মাংসপিণ্ড না হয়ে ওঠে, ব্যক্তিত্ব অর্থ বিদ্রোহ নয়। সন্তান মুরুব্বীদের অবাধ্য হোক বা তাদের অশ্রদ্ধা করুক এ বলছি না। সৈনিকেরা নিজের ব্যক্তিত্ব না হারিয়েও সেনাপতির আদেশে কামানের সম্মুখে প্রাণ দেয়।
ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলতে চেষ্টা করবে। এর অর্থ–সন্তান যেন সত্য অপেক্ষা মানুষের হুমকিকে বেশি ভয় না করে, কারো সম্মুখে যে নীচ ও হীন হয়ে না দাঁড়ায়, কারো সঙ্গে কথা বলতে তার গলা না কাপে। ভয়ে অনিচ্ছায় সে যেন না হাসে বা কাঁদে, প্রয়োজন হলে। প্রতিবাদ করতে ভয় না পায়, অনুগ্রহ বা কারো কৃপা দৃষ্টি লোভে কুকুরের নীচতায় কারো কাছে মাথা নত না করে।
ছোট ছেলেমেয়েকে মাঝে মাঝে ক্ষেপা কুকুরে কামড়ায়। সাবধান, পল্লীগ্রামের আনাড়ী বৈদ্যের ওষুধে শান্ত হয়ো না। ক্ষেপা কুকুরের নিচের চোয়াল ঝুলে পড়ে, মাথায় তার কখনও কখনও ঘা থাকে–অনবরত মুখ হতে লালা নির্গত হতে থাকে, চোখ দুটি লাল হয়, লেজটি ঝুলে থাকে, এরূপ কুকুরে কামড়ালে আর রক্ষা নেই। কুঁড়েমি করে বাড়িতে বসে সর্বনাশ করো না, মহকুমা বা জেলার ম্যাজিষ্ট্রেট জানাতে হয়! তিনি সরকারি খরচে হসপিটালে পাঠাবার ব্যবস্থা করে দেন। ভালো পোষা কুকুরে কামড়ালে বা আঁচড়ালে বিশেষ ভয়ের কারণ নেই। তবুও সাবধান হওয়া ভালো। বিশেষ বিবেচনা করে দেখবে কুকুরটি ভালো কি ক্ষেপা। কোনো ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া ভালো। কামড় দেবার পর এক সপ্তাহের মধ্যে যদি কুকুর পাগলা হয়, তাহলে বিশেষ ভয়ের কারণ থাকে। ক্ষেপা। কুকুরকে কিছু খেতে দিলে সে খায় না বলে মনে হচ্ছে-সাবধান খুব সাবধান।
সন্তানকে সাপে কামড়ালে তৎক্ষণাৎ দংষ্ট্র স্থানের উপর দিয়ে বাঁধের উপর বাঁধ দেবে। দংশিত স্থান চাকু দিয়া কেটে ফেলবে-মায়া করেছ কি সর্বনাশ হয়েছে।
একটা কথা জানি। এক ভদ্রলোক ছেলে নিয়ে রাত্রে শুয়েছিলেন। ঘুমঘোরে একটা সাপ এসে ছেলের হাত কামড়েছিল। ছেলের চীৎকার শুনে বাপ জাগলেন। অন্ধকারেই হাত দিয়ে দেখলেন, সাপটি হাতের সঙ্গে তখনও লেগে আছে। কিছুতেই ছাড়ছে না। বাপ সাপের গা চেপে ধরে টেনে দূরে ফেলে দিলেন। তারপর কাপড়ের পাড় ছিঁড়ে হাতের উপর বাঁধনের উপর বাঁধন দেওয়া হল। ক্রমে বহু লোকজন সেখানে জমা হল। কতকগুলি ডাক্তারও এলেন। আশ্চর্যের বিষয় তারা কেউ কিছু বললেন না, কেবল হা-করে চেয়ে রইলেন। সাপটিকে ইত্যবসরে মেরে ফেলা হয়েছিল।
একজন প্রবীণ ডাক্তার বললেন–এ সাপের বিষ নেই–অতএব সন্তানকে আর কষ্ট দিয়ে লাভ কি? বাঁধন খুলে দাও–ভোর হতে এখনও বিলম্ব আছে। ছেলেটি একটু ঘুমোক,–তখন। সকলে বারান্দার উপর বসেছিল। বাধনের যাতনায় ছেলে একটু একটু কাঁদছিল।
হায়, বন্ধন খোলামাত্র সোনার সুন্দর ছেলেটি কাত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। মুহূর্তের দেরি সইল না। ছেলেটি চিরদ্রিায় অভিভূত হল। সকলে নির্বাক, স্তব্ধ ও স্তম্ভিত হয়ে গেল। হায়! দুর্ভাগ্য, ভুল!
ছোট ছোট ছেলেপেলেকে দেখলেই আদর করবে। ভবিষ্যৎ কালে সে তোমার পায়ের ধুলা নেবে বলে তাকে আদর করো না, সে মানুষ হোক, দেশ সেবক হোক এই কামনা করো। সন্তানের পায়ের কোনো স্থান থেকে রক্ত পড়লে তাৰ্পিন তেল দিয়ে এঁটে বেঁধে দিও। কাটা ঘায়ে পানি-পট্টি দিও। আগুনে পা পুড়ে গেলে চুনের পানি ও নারিকেল তেল লাগাবে। হাত ভাঙ্গলে দুই পার্শ্বে কাঠ দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিলে হাড় জোড়া লাগে। কোনো বিষ ছেলে-মেয়ের পেটে গেলে তৎক্ষণাৎ বমি করাবে। গরম পানিতে লবণ মিশিয়ে খাওয়ালে বমন হয়। বোলতা কামড়ালে পেঁয়াজ বেঁটে লাগিও।
সন্তানদের বিছানায় মুতা একটা ব্যারাম। হোমিওপ্যাথিক ওষুধ খাওয়ালে সহজে আরোগ্য হয়।
হালিমা জিজ্ঞাসা করিলেন–ছেলেমেয়েকে কিরূপ স্থানে বিয়ে দেওয়া উচিত?
কুলসুম বলিলেন, জ্ঞান ও চরিত্রের সেবা না করে শুধু হছব নছব (সম্বন্ধ) করে নিজের বংশমর্যাদা বাড়াতে চেষ্টা করা লজ্জার বিষয়। সাধারণের কাছে ছোট লোক আখ্যার ছাপ মাথায় নিয়ে তথাকথিত ভদ্রলোকের সঙ্গে সম্বন্ধ করা ভালো কাজ নয়। সামনে সামনে সম্বন্ধ হওয়া ভালো। এক শ্রেণীর লোক আছে, তারা পাপকে ঘৃণা করে না–জ্ঞান ও চরিত্রকে সম্মান করে না, শুধু সাদীর দ্বারা সম্মান অর্জন করতে চেষ্টা করে–এরা কৃপার পাত্র। আত্মমর্যাদা নিয়ে স্বাধীনভাবে দাঁড়ানই সম্মান। সম্মান নিজের ভিতর–নিজের সম্মানের মালিক নিজে।-এ জিনিস ভিক্ষা করবার নয়। স্বাধীনচিত্ত লোক তথাকথিত বড়লোক ও বড় ঘরের কন্যাকে বিয়ে করতে অপমান বোধ করেন। তোমার প্রীতি-উপহার বইখানিতে যে সংস্কৃত শ্লোকটি লেখা আছে, তার অর্থ–যে নিজের নামে পরিচিত সে উত্তম, যে পিতার নামে পরিচিত সে অধম, যে মামার নামে পরিচিত সে অধম, যে শ্বশুরের নামে পরিচিত সে অধমের অধম।