ছেলেকে বর্তমানযুগে ব্যবসায়ী করতে চেষ্টা করা উচিত। শুধু রাজকর্মচারী ছাড়া দেশের আর কারো সম্মান নেই, একথা মনে করা ভুল। সাধারণ দেশবাসী ও ব্যবসায়ীদের সম্মান রাজকর্মচারীদের চেয়ে বেশি একথা আমাদের দেশের লোক বোঝে না। কারণ আমরা ছোট, আমরা ছোট হয়ে গিয়েছি, তাই আমরা নিজকে নিজে বড় মনে করতে শিখি, নাই। রাজকর্মচারী দেখে ছেলে-মেয়ে যেন ভয়ে কাঁপতে না থাকে, রাজকর্মচারীদের সঙ্গে ছেলে করমর্দন করবে, তাদের সেজদা করতে ছেলেমেয়েকে একদম নিষেধ করবে। রাজকর্মচারীরা দেশের লোকের চাকর-একথা ছেলেমেয়েকে বলে দিতে হবে। স্বাধীনভাবে ব্যবসা করে ছেলে কোটি কোটি টাকা উপায় করতে পারে–এরূপ বিশ্বাস মনে পোষণ করা উচিত। একটা ছোট হীন দারোগাগিরি চাকরির জন্য লালায়িত হওয়া রোজা করা কি দারুণ অসম্মানের কথা নয়? সন্তানেরা চাকরির জন্য কাউকে খোশামোদ করো না। নবাব সাহেব বা নবাব সাহেবের বেগমের সাথে সই পাতিও না।
সন্তানদের গায়ে খুব বেশি ছেঁড়া-ফাটা জামা না দেওয়াই উচিত-এটা দীনতার বিবৃত চিত্র।
বৎসর শেষে প্রমোশনের সময় ছেলেমেয়েরা বই কেনার নাম করে অনেক টাকা নিয়ে যায়। তা ছাড়া অন্য সময়েও সন্তান একথা ওকথা বলে ফাঁকি দিয়ে মার কাছ থেকে টাকা চায়। উপযুক্ত কারণ থাকলে টাকা না দেওয়া ভালো নয়। ষোল সতেরো বছরের সন্তানকে স্বাধীনভাবে টাকা পয়সা নিয়ে কোথাও থাকতে দেওয়া অনুচিত।
সন্তানকে সর্বদা সত্য কথা বলতে উৎসাহ দেবে। শত অপরাধ করেও সত্য সন্তান যদি সত্য কথা বলে, কিছু বলো না, চুপ করে থেকো।
সন্তান যদি লজ্জাজনক কাজ করে ফেলে, তাহলে তার সঙ্গে বিশেষ রাগারাগি করো না, বুঝিয়ে দিও। এরূপ কাজ অন্যায় ও খারাপ। সন্তান যাতে লজ্জা পায় এরূপ কাজ করা মাতা পিতার কর্তব্য নয়। ছেলেমেয়ের নিন্দা ও কুৎসা কখনও তৃতীয় ব্যক্তির নিকট করো না।
ছেলে শিক্ষার জন্যে যেমন আমরা ব্যস্ত হই মেয়ের শিক্ষার জন্যে তেমনি করে ব্যস্ত হতে হবে।
হিন্দুরা মেয়ে হলে ভয়ে কাঁপতে থাকে। মুসলমানদের ছেলে এবং মেয়ের কোনো। তফাৎ নেই। মেয়েকেও ছেলের মতো লেখাপড়া শিখতে হবে। আজকাল টাকার লোভে লোকে সন্তানকে লেখাপড়া শিখায়; আসলে কারো ধর্ম ভয় নেই। কোরানের হুকুমও কেউ মানে না। মেয়েকে বাল্যকালে হুনর, হিকমত এবং শিল্প শেখাবে, কি জানি ভবিষ্যৎ জীবনে তার কপাল যদি খারাপ হয়, তাহলে তাকে পথে ভাসতে যেন না হয়।
মেয়েকে অর্থ ও জমাজমি লিখে দিলেও শিক্ষা ও বহির্জগৎ সম্বন্ধে জ্ঞান ব্যতীত সে তা রক্ষা করতে পারে না। অনেক মেয়েই জানে না, কলকাতা কোনো মানুষের নাম, না কোনো স্থানের নাম। জেলা কাকে বলে, মহকুমা ও রাজধানী কাকে বলে-মেযেকে-শেখাতে হবে! ক্রিমিনাল কোর্ট, সিভিল কোর্ট থানা রেজিষ্ট্রারী অফিস কাকে বলে এসবও মেয়েকে জানান চাই। আমাদের দেশ কোথায়; পৃথিবীটা কেমন এ সমস্ত জিনিস যেন মেয়ের মনে শুধু কল্পনার, জিনিস হয়ে না থাকে। শিক্ষিতা মেয়েই মানুষের মতো মানুষ সন্তান প্রসব করতে সক্ষম।
অনেক স্থানে বোরকা পরতে হয়। বোরকা পরতে হলে লক্ষ্ণৌতে এক রকম বোরকা পাওয়া যায়, তা মেয়ের জন্য একটি কিনবে। এ বোরকা গায়ে দিয়ে পাড়াগাঁয়ের বোরকা পরিহিতা মেয়েদের ন্যায় একটা ঝুড়ির মতো চেহারা হয় না। লক্ষ্ণৌ-এর বোরকার আরও উন্নতি হওয়া আবশ্যক। এখনও তা পরে হাতে-পায়ের স্বাধীন মুক্ত ব্যবহারের সুবিধা হয় না। কিন্তু তবুও সেগুলি বোরকার আরও উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারা যায়। দেখতে মন্দ নয়। ছোট থাকতেই মেয়েকে সর্বত্র পাঠাবে। জগৎ ও মানুষের মধ্যে না গেলে। মানুষের বিকাশ হয় না লেখাপড়ার উন্নতি হয় না, জ্ঞান পূর্ণ হয়ে ওঠে না। বই পড়ার চেয়ে চোখে দেখে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি। চোখে কিছু না দেখে, পুরুষ সমাজ যদি শুধু বই পড়েই বিদ্যা খতম করতো তা হলে তারা একপাল গাধা হয়ে থাকতো। বাল্যকাল হতেই মেয়েকে বাইরে শহরে, রাজধানী, কোর্টে রাস্তায় এবং সভায় পাঠাবে। অন্তঃপুরে পিঞ্জিরাবদ্ধ হয়ে থাকবার অভ্যাস যদি একবার হয়ে যায়, তাহলে জীবনে আর বের হওয়া যাবে না। বাল্যকাল হতেই মেয়েকে বাইরের সঙ্গে সংস্রব করে দেবে; সে পুরুষের মতোই একটা শক্তি হয়ে উঠবে। বর্তমান সময়ে সভ্য জাতির সঙ্গে প্রতিযোগিতা আমাদের করতে হবে, নইলে জাতি হিসাবে ছোট ও দুর্বল হয়ে পড়তে হবে, বেঁচে থাকা কঠিন হবে; উভয়কে কাজ করতে হবে; নইলে জীবন সংগ্রামে পৃথিবীর উন্নত জাতির কাছে আমরা হেরে যাবো।
চরিত্র হারাবার কোনো ভয় নেই। পুরুষ কি নিজের চরিত্র শহরে যেখানে শত বিলাসিনী রূপ মেলে পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে বীরের মতো পাপকে উপহাস করে ঘুরে বেড়ায় না?
পাড়ার অন্যান্য মেয়ের সঙ্গে মেয়েকে কথা বলতে শিখতে উৎসাহ দেবে। ছেলে যেমন ছেলেদের সঙ্গে মেশে, মেয়েও তেমনি মেয়েদের সঙ্গে মিশবে। মানুষের সঙ্গে না মিশলে মানুষের বুদ্ধিশক্তি বাড়ে না।
মেয়েকে খবরের কাগজ এবং মাসিক পত্রিকার গ্রাহক করে দেবে। মেয়েকে মানুষ করবার কাজ মা-বাপের, স্বামীর নয়। অনেক অপদার্থ মা-বাপ মেয়ের শিক্ষার ভার স্বামীর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে কাপুরুষের মতো সরে দাঁড়ান।