সন্তানকে বক্তা করে তোলা বড় উত্তম। এজন্য সাধনা চাই। বক্তৃতাকালে ধীর ও স্বাভাবিক হলেই সফল হওয়া যায়।
ছেলেমেয়েদের ১০-১২ বৎসর বয়স হলে অর্থাৎ কিছু বুদ্ধি হলে, তাদের সভার উপদেশপূর্ণ বক্তৃতা শোনাবে। পাড়া-প্রতিবেশী ছেলেমেয়েকে একত্র করে যদি তাদের মধ্যে উপদেশপূর্ণ বক্তৃতা দেওয়া যায়, তাহলে যে উপকার হয়, তা দশ বছর বই পড়িয়ে হয় না। ছোট বড় সকলের কাছেই বক্তৃতা উপকারী।
সন্তান যদি কারো বিরুদ্ধে নিন্দা করে, তবে হঠাৎ তা বিশ্বাস করা ঠিক নয়। তার অভিযোগ যদি সত্য বলে প্রমাণিত হয়, তাহলে বিবেচনা করে যা করতে হয় করবে।
তামাসা বা খেলার ছলে, সন্তানকে মুহূর্ত বিলম্ব না করে আজ্ঞা পালন করতে অভ্যস্ত করবে। ছোট ছেলেমেয়ে তখন আজ্ঞা পালন না করলে, অনেক সময় বিলম্ব না করে শাস্তি দেওয়া উচিত। একটু বড় হলে এ নিয়ম খাটে না, বারে বারে শাস্তিদান এবং ক্রোধ প্রকাশ নিষেধ।
ছেলেমেয়ে তামাক খেলে, সেজন্য বেদম প্রহার করো না-তাকে বলবে এ কাজটা খারাপ। ছেলেমেয়ের এরূপ কাজ খুব দুঃখের বিষয় বটে, কিন্তু বেদম প্রহার করলে তার চরিত্রের আরও পতন হতে পারে। সে ভাববে, না জানি এইসব কু-জিনিসে কি মধু না আছে।
ছেলেপেলেকে তামাক সাজতে বলা বা হুক্কা আনতে বলা নিষেধ।
ছেলেমেয়েদের বসন্ত প্রভৃতি ছোঁয়াচে রোগে অধীর হয়ে অবিবেচনার পরিচয় দেওয়া উচিত নয়। সর্বদা স্বতন্ত্র করে রাখবে।
হোমিওপ্যাথিক ‘ভরিওলিনাম’ নামক ঔষধ খেলে বসন্ত হয় না।
সন্তানকে গালি না দিয়ে বা লজ্জা না দিয়ে কাজটা অন্যায় তা বলে দিতে হবে। এ সব ব্যাপারে শাসন বা গালি শিক্ষকদের হাত হতেই হওয়া উচিত।
মেয়েদের সাজসজ্জা করতে দোষ নেই, বরং না করাই দোষের।
ছেলেমেয়ের শিক্ষক দুর্বলচিত্ত হলে ছেলেমেয়েদের চরিত্রের উন্নতি হয় না। যে শিক্ষক-শিক্ষিকা সন্তানকে শাসন করতে ভয় করেন না, যে শিক্ষক শিক্ষয়িত্রী ছাত্র-ছাত্রীর মাতাপিতাকে ভয় করেন, সে শিক্ষক-শিক্ষিকার দ্বারা সন্তানের ভালো শাসন হয় না।
ছেলেপেলে যেন মায়ের বিনা অনুমতিতে কখনও কোথাও না যায়। ইচ্ছামতো ছেলেমেয়েরা যেখানে সেখানে গেলে, তাদের স্বভাবে নানা দোষ ঢুকবার সম্ভাবনা। দোষ ঢুকুক, চাই না ঢুকুক, বিনা অনুমতিতে ছেলেমেয়েদের বাইরে ঘুরে বেড়ান দোষের। ছেলেমেয়েদের জন্য বাড়িতে কতকগুলি আকর্ষণ সৃষ্টি করতে হবে, মিষ্টি ভাষায় বাড়িতে থাকতে বলা চাই, এজন্য হরদম তাম্বি নিষেধ।
উত্তম পুষ্টিকর খাদ্য হলে, অল্প ব্যায়ামেই শরীর ভালো থাকে। ছেলেমেয়ের আহারের প্রতি বিশেষ নজর চাই। সকলের জন্যেই পুষ্টিকর খাদ্য আবশ্যক-নইলে শুধু ব্যায়াম করলে শরীর থাকে না। পুষ্টিকর খাদ্য না খেয়ে, কঠিন ব্যায়াম করলে কঠিন পীড়া হয়। অবসন্ন পেশিগুলো খাদ্য না পেলে হৎপিণ্ড ও ফুসফুস হতে অন্যায় রকমে খাদ্য সংগ্রহ করে। ফলে হৃৎপিণ্ড ও শরীরের অতি উপকারী যন্ত্রগুলি দুর্বল হয়ে ব্যাধি আক্রমণের পথ প্রশস্ত করে দেয়। মাংস ডিম, দুধ, ঘি, এই সবই ভালো খাদ্য। মুরগি ও পায়রার মাংস উপকারী। বাজারের মিষ্টান্ন খেয়ে লাভ নাই। পুষ্টিকর খাদ্য ব্যতীত স্বাস্থ্য রক্ষা করা সম্ভব নয়। ওষুধ খেয়ে শরীরকে শক্তিশালী করবার চেষ্টা মূর্খ।
ছেলে-মেয়েকে মাঝে মাঝে বাপ, মা এবং বড় ভাই-বোনকে আদর করে খাওয়াতে শিক্ষা দেওয়া ভালো। এতে শিশু উদার-হৃদয় ও পরার্থ হয়ে উঠবে। নিজের সুখের কথা
অপেক্ষা অন্যের সুখের কথা ভাববার অভ্যাস বাপ-মাকেই শিক্ষা দিতে হবে।
সন্তান কারো কাছে অপরাধ করলে সে যদি বিচার প্রার্থনা করে, তবে নিজের সন্তান বলে কখনও তাকে মাফ করো না। ছেলেমেয়ে কু-কাজে অনেক সময় প্রশ্রয় দিয়ে সর্বনাশ করেন। মায়ের দোষে বহু সন্তানের জীবন মাটি হয়ে যায়। কেউ সংশোধন করতে পারে না। ছেলেপেলেদের সব ভাই-বোন সব সময় এক সঙ্গে বেড়ান উচিত। যার যার মতে বেড়ালে বিশেষ ভয়ের সম্ভাবনা। দলে দলে একসঙ্গে বেড়ালে কু-পথে যাওয়ার ভয় থাকে না।
সন্তানদের পতন আরম্ভ হয়েছে এরূপ সন্দেহ হলে তাদের সহানুভূতিভরা প্রাণে বলবে–তুমি সুন্দর, তুমি পবিত্র। তোমাকে কি কেউ দুষ্ট কথা বলে থাকে, বাপ?–তোমাকে। কি কেউ খারাপ কাজ করতে বলে? সেই সব দুষ্টদের তুমি ঘৃণা করো, কারণ, তুমি ভালো–তাদের চেয়ে বড়। মানুষ অনেক সময় কু-কাজ করে–নিরুপায় হয়ে মানসিক শক্তির অভাবে যদিও সে কাজকে ঘৃণা করে। বন্ধুর মতো সন্তানের ভিতরে পাপ ও অন্যায়ের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করবে। তার মানসিক শক্তিকে সহানুভূতির দ্বারা প্রবল করে তুলতে হবে। তখন তখন সন্তান সংশোধিত হতে না পারে, কিন্তু সে ফিরে আসবেই। গম্ভীরভাবে বন্ধু বেশে পাপ হতে ছেলেপেলেকে রক্ষা করবার জন্য তাদের পার্শ্বে দাঁড়াতে হবে।
সন্তানের অভিমান ও ক্রোধ দেখে অনেক সময় ধৈর্য ধারণ করা উচিত। সন্তানেরা পরস্পরের মধ্যে শ্রদ্ধার সঙ্গে কথা বলবে—’তুই-তুই’ বা ‘রে-রে’-করে কথা বললে বিরক্তি প্রকাশ করবে।
মানুষের পেছনে বিক্রম প্রকাশ করতে ছেলেমেয়েদের নিষেধ করবে, যা বলার আছে। তা সামনে প্রকাশ করার জন্য বলবে। –বড় ছেলে বা মেয়েদের কথা ও কাজ সমালোচনা করা নিষেধ। তাতে তাদের উন্নতি না হয়ে ক্ষতি হয়। সোজাসুজি তখন তখন দোষের অনবরত সমালোচনা হতে থাকলে, বিশেষ লাভ হয় না। বরং এরূপ সমালোচনাকে বড় হীনআসন পেতে হয়। মানুষের ভিতরে স্বতন্ত্র রকমের অন্যায়ের ঘৃণা সৃষ্টি কর, দোষের কথা মোটই না ভেবে, তাকে শুধু জ্ঞান দিতে থাক, তাকে মহত্ত্ব ও পুণ্যের কথা শুনাও, তাকে ভালবাস, তাকে লেখাপড়া শেখাও তার মনকে উন্নতি করতে চেষ্টা কর, তার ভুল আপনা আপনি ঝরে পড়বে। মানুষকে এই ভাবেই বড় করা যায়।