হালিমা : স্বামী যা বলেন, তাই করতে হবে। তাকে ভক্তি করতে হবে। এসব কথার অর্থ কি? এত শ্রদ্ধার আদান-প্রদান, যেখানে-সেখানে প্রেম প্রণয় কি প্রকারে সম্ভব? স্বামীকে এত ভয় করে কি জীবনী ধারণ করা যায়? স্ত্রীলোককে স্বামীর বাড়ি যেয়ে দরকার কি? পুরুষ তার শ্বশুর শাশুড়ীর আজ্ঞা পালন করতে বাধ্য নয়, নারী তার শ্বশুর-শাশুড়ীর আজ্ঞা পালন করতে বাধ্য, এর অর্থ কি? পুরুষ শ্বশুর-শাশুড়ীর আজ্ঞা অনুযায়ী কাজ করলে লোকে তাকে কাপুরুষ বলে; নারী শ্বশুর-শাশুড়ীকে অবজ্ঞা করলে সকলের কাছে সে নিন্দনীয় হয়। এর কারণ কি?
কুলসুম : সাধারণত স্বামী স্ত্রী অপেক্ষা জ্ঞানী হয়ে থাকেন, সুতরাং তার কথামতো কাজ করতে কোনো ক্ষতি নেই। কাজ হওয়াই চাই–স্ত্রী ও স্বামীতে আড়াআড়ি ভাব থাকলে পরিবারে সুখ-শান্তি তাকে না, কোনো কাজও হয় না। স্বামী-স্ত্রীর অমঙ্গল চান না–বন্ধুর কথামতো কার্য হওয়া চাই তাতে নিরানন্দের কারণ কি? স্ত্রী যদি স্বামী অপেক্ষা শিক্ষিতি ও জ্ঞানী হন, তাহলে স্ত্রীর কথামতো কাজ হতে পারে। শিক্ষিত ও জ্ঞানী স্বামীকে ভক্তি শ্রদ্ধা করার অর্থ দিবারাত্র পদপ্রান্তে লুটিয়ে থাকা নয়। পিতার কাছে পুত্রের ব্যক্তিত্ব বা কথার মর্যাদা বা দাবি নাই, স্ত্রীর তা আছে; সুতরাং স্ত্রীর দুঃখ করবার কিছু নাই। অতএব প্রেম প্রণয় পূর্ণ গতিতে চলতে পারে। স্বামীকে ভয় করতে হয় না। স্বামীর ভালবাসাকে বিশ্বাস। করতে হবে। নারীর হাতে যদি কাবিন থাকে–সে যদি শিক্ষিতা হয়, সে যদি সম্মান বজায়। রেখে প্রয়োজন মতো এখানে ওখানে যাওয়ার ক্ষমতা পায়, তা হলে তার স্বামীকে বিশেষ ভয় করতে হয় না। স্ত্রীলোকের স্বামীর বাড়ি থাকার কারণ এই বাঙালি সংসারের নূতন নূতন পরিবার গঠন করা কঠিন। আমরা স্বামীর মাতা-পিতাকে নিজের মাতাপিতা মনে করি, সুতরাং তাদের খেদমত করতে আনন্দই হয়। পুরুষ স্ত্রীর গৃহে এলে স্ত্রীরই ক্ষতি। তাতে পুরুষের সম্পর্ক খর্ব করা হয়। ফলে সন্তানাদি কাপুরুষ হয়ে জন্মে। বাৰ্হিজগতের সঙ্গে পুরুষের সম্বন্ধ অধিক-জতের ভাব ও কর্মকে সেই গতি প্রদান করি। সে নারীর বাড়ি এসে নারীর মাতাপিতার বাক্য অনুযায়ী চলতে পারে না–তাতে তার জীবন মিথ্যা হয়ে যায়।
হালিমা : ঊষার স্নান শেষ করে বধূ কি করবে?
কুলসুম : স্বামীর তামাক খাবার অভ্যাস থাকরে তামাক ঠিক করে রাখবে। বদনায় পানি ভরে কোনো নির্দিষ্ট স্থানে রেখে দেবে। গোছলখানায় গামোছা আর কাপড় রেখে অজু করে নামাজ পড়বে। নামাজ পড়ে বাড়িতে দাসী না থাকলে কলমদানীতে পানি দেবে বদনাগুলি মেজে নির্দিষ্ট স্থানে গামছাসহ রেখে দেবে। শ্বশুরের তামাক খাবার অভ্যাস থাকলে হুঁকায় পানি বদলিয়ে কলকায় তামাক দিয়ে দেশলাই ও কয়লা কাছে রেখে দেবে। শ্বশুরের খেদমত শাশুড়ীও করতে পারেন-বধু সাধ্যমতো শাশুড়ীকে সাহায্য করবে।
হালিমা : ছেলে হলে স্বামীর খেদমত ঠিক মতো করা যায় না বোধ হয়?
কুলসুম : একটু বাধা আছে। যতটুকু সম্ভব তা করতে অবহেলা করবে না।
হালিমা : স্বামী যখন আহার করেন তখন স্ত্রীর কিছু কর্তব্য আছে না কি?
কুলসুম : নিশ্চয়ই। সে কথা জিজ্ঞেস করে আর কষ্ট করার দরকার কি আসন দিয়ে দস্তরখানা ও পানি দিও। দাস-সাসী অনেক সময় পানি ও দস্তরখানা না দিয়েই ভাত নিয়ে হাজির হয়। এরূপ দাস-দাসীকে আদব-কায়দা শিখাবে। বিনা দস্তরখানে বাড়ির কেহ যেন ভাত না খায়।
হালিমা : পানি ও দস্তরখানা দিয়ে বুঝি ভাত দিতে হবে?
কুলসুম : হ্যাঁ, প্রথমে সামনে যে ভাত দেবে তা যেন কখনও বেশি না হয়। স্বতন্ত্র থালায় সম্মুখে ভাত রেখে চামচ দিয়ে নিজ হস্তে অল্প অল্প ভাত স্বামীর পাতে উঠিয়ে দিতে থাকবে। এক সময়ে অনেক ভাত স্বামীকে দিও না। পাত্রে তরকারি দেবে। নিজ হস্তে তরকারি তুলে দিতে হয়। খাবার সময় স্বামীকে আদর করে আরও কিছু নিতে অনুরোধ করতে হয়। স্বামীর পরিতুষ্ট আহারে তুমি খুব খুশি এরূপ ভাব দেখান চাই। স্বামী যত কম খান ততই স্ত্রী খুশি হন, এরূপ সন্দেহ যেন কখনও স্বামীর মনে না আসে।
হালিমা : অনেক রমণীকে দেখে থাকি স্বামীর ভাত খাবার সময় পাখা দিয়ে তার। স্বামীকে বাতাস করতে থাকে।
কুলসুম : এতে খুব ভালো কথা-স্বামীর আহারকালে বাতাস দেওয়া খুব ভালো। গরম ভাতের উপর স্বামী উপুড় হয়ে ফুঁ দিচ্ছেন তা দেখে চুপ করে থাকতে নেই। বাতাস দিয়ে ভাত ঠাণ্ডা করে দেবে। স্বামীকে যেন পানি বা লবণ দিতে ভুল না হয়। ভাত খাবার সময় ভাতের উপর মাছি না বসে, সেদিকেও লক্ষ রাখবে। ছেলেপিলেকে ছেড়ে দিয়ে। খাবার সময় বিরক্তি করা ঠিক নয়। ছেলেপিলেকে স্বতন্ত্র স্থানে খেতে দিলে, কাঁদা কাটির অভিনয় বন্ধ হতে পারে।
হালিমা : স্বামী পরিশ্রান্ত হয়ে এলেও তাঁকে পাখা দিয়ে বাতাস করতে হবে না কি? লোকে কী বলবে? লজ্জা লজ্জা!
কুলসুম : লোকে কী বলবে–এই ভেবে ক্লান্ত স্বামীর নিকট যে রমণী অগ্রসর না হয় তার জীবন বৃথা। স্ত্রী তো আর উপপত্নী নয় যে লোকের কথা শুনবে। এমন নরপিশাচ কে আছে যে স্ত্রী লোকের স্বামীর প্রতি ভালবাসা দেখে বিরক্ত হয়?
হালিমা : এত সেবা করে কি জীবন ধারণ করা যায়?