নিথর নৈশ আকাশ,তারাগুলি মৃত্যুর গান শোনাচ্ছে,-করুণ শোকের মূর্ধনা দিয়ে বাতাস বিশ্বজোড়া যৌনতার বুকের উপর দিয়ে হা হা করে ছুটছে–এমন সময় রোগজীর্ণ মরণ পথের যাত্রীকে দেখে কে ঘুমাতে পারে? কেউ না! হালিমা! সহানুভূতি, স্নেহ আর আঁখিজল নারীকে যে কত, বড় করেছে, তা আমি ঠিক করে বলতে পারি নে। কে বলে ভাগ্যহীনরাই নারী হয়ে জন্মগ্রহণ করে? নারীর দেহলাবণ্যে স্বর্গের সংবাদ এনে দেয়, তার হৃদয়ে বিশ্বজীবনের প্রাণরস নিহিত, তার হাসিতে আলোক-বাতাস অধীর আবেগে ছোটে, সাগর কল্লোলে নারীর জয়-সঙ্গীত শোনা যায়, তার চোখে মুখে প্রভাতের স্নিগ্ধ শান্তি-উৎসব হাসে, তার ললাটে গগনপ্লবী জোছনার মাধুরী ফোটে, সে কি সহজ? এহেন নারীকে যে অশ্রদ্ধা করে, সে নরাধম, সে নরপিশাচ।
নারীদের কিছু কিছু ঔষধের জ্ঞান থাকা নিতান্ত আবশ্যক। এতে কত নারীর যে উপকার করা যায়, তা বলে শেষ করা যায় না। নারীরা অনেক কষ্টে বিনা চিকিৎসায় মরে যায়, কেউ তাদের দেখবার থাকে না। কাউকে ঔষধ দিতে হলে কিছু মূল্য নিতে হয়। আর সেধে কাউকে ঔষধ খাওয়াবে না। কেউ তোমার নিতান্ত যে দয়া ভিক্ষা করে এবং ঔষধের প্রতি শ্রদ্ধা দেখায় তার কাছ থেকে দাম কম নেবে। অক্ষমতা প্রকাশ করলে মোটেই নেবে না। আমি চিকিৎসার কি জানি, এরূপও মনে করবে না, সব কাজেই সাহস ও বিশ্বাস চাই। গ্রামসুদ্ধ লোককে সেবা করে বেড়াতে হবে, এ আমি বলছি নে। যার কেউ নেই, তুমি হবে তার আত্মীয়। যেখানে সেবা-যত্ন করবার যথেষ্ট লোক আছে সে ক্ষেত্রে জোর করে সেবা করবার দরকার নেই।
খ্রিষ্টানদের ভিতরে একদল নারী আছেন যারা চিরকাল অবিবাহিতা থেকে রোগী বা। আর্তের সেবা করে বেড়ান। বাইরে এতে এদের জীবন নিয়ে কল্পনা করতে মনে খুব শ্রদ্ধার ভাব জাগে, কিন্তু স্বভাবকে অস্বীকার করে মনুষ্যত্বের পরিচয় দেওয়াও দোষের। এদের জীবনে বহু গোপন পাপ রয়েছে। ইসলামের প্রত্যেককে পরিপূর্ণ মানুষ হতে হবে। যিনি রানী, তিনিই পত্নী, তিনিই মা, তিনিই দাসী, তিনিই সেবিকা, তিনিই আর্তের বন্ধু।
কুলসুম আবার বলিলেন–যদি কোনো বিপন্ন আত্মীয়া বা স্বামীর বোন অনাথিনী হয়ে বাড়িতে আসেন, তবে তার সঙ্গে কখনও কঠিন ব্যবহার করবে না।
হালিমা মুখ ভার করিয়া বলিলেন–ওমা, এমন ধারা কি কখনও হয়ে থাকে?
কুলসুম-বোন, হয় বই কি? অভাব হলে সংসারে আপন জনের মধ্যে কলহ বিবাদ উপস্থিত হয়। তবে এরূপ হওয়া মোটেই বাঞ্ছনীয়। আল্লা রুজির মালিক, তিনি সকলকে খোরাক দেন, মানুষ উপলক্ষ মাত্র। অনেক সময় অভাব না থাকলেও, যে অনাথিনী, যে দরিদ্র, তার উপর বড় চাপ দেওয়া হয়। আহা, অনাথিনী হওয়া, আর অভাগিনী হয়ে ভাই এর বাড়ি অনুগ্রহ চাইতে আসার মতো কষ্ট কি আর আছে? এ অবস্থায় যে নারী স্বামী ও সন্তানের গর্বে আশ্রিতাকে কঠিন কথা বলেন তিনি বড় হীন। বাড়িতে যে আশ্রয় নিয়েছেন তার অপরাধটা স্নেহের চোখে দেখো। তার ছেলেমেয়েকে কখনও অনাদর করবে না,–বিশেষ করে সে নিজের আত্মীয় কেউ হলে।
অসভ্য বর্বর শ্রেণীর রমণীকে বাড়িতে স্থান দিলে জীবনে অশান্তি বেড়ে ওঠে। তাদের জন্য কোনো স্বতন্ত্র ব্যবস্থা করে দেবে। স্বভাব যাদের ভালো, তাদের প্রতি শত রকমে করুণা প্রকাশ করলেও কোনো ক্ষতি নেই। তবে স্বভাব ঠিক মন্দ কি ভালো, এ ঠিক করা অনেক সময় কঠিন। যার কিছু নেই, যে পরমুখাপেক্ষী, তার দোষের অন্ত নেই, মানুষ তাকে খেয়ে ফেলতে চায়, তার গুণ কারো নজরে পড়ে না। যার নিতান্ত কপাল পুড়েছে, জীবনে বেঁচে থাকবার কোনো পৰ্থ যার নেই, সে-ই পরের দ্বারস্থ হয়।
২১-২৩. কী করে সন্তান গঠন করতে হয়
একবিংশ পরিচ্ছেদ
কুলসুম বলিলেন–কী করে সন্তান গঠন করতে হয় তা তোমাকে জানতে হবে। মায়ের দোষে ছেলে বড় ও ছোট হয়। ছেলে বেয়াদব এ কথা যেন কেউ না বলে। সন্তানের বেয়াদবির জন্য বাপ এবং বেশি করে মা দায়ী। মা যেমন মানুষের ভক্তির পাত্র, তার কাজ। এবং দায়িত্বও তেমনি বেশি। শুধু কাঁদলেই ছেলে বড় হবে না (বড় অর্থ বয়সে বড় নয়,)। ছেলেকে বড় করতে হলে মাকে বিচক্ষণ ও চিন্তাশীল হতে হবে। ছেলের পাঁচ বৎসর পর্যন্ত মা-ই তার চরিত্র গঠন করবেন। তারপর ছেলের অভিভাবক পিতা।
হালিমা জিজ্ঞাসা করিলেন–ছেলের জন্য মা কেন দায়ী?
কুলসুম : ছেলে সর্বদা বাল্যকালে মার কোলে পালিত হয়। মা’র কথা, ব্যবহার শিশু অনুকরণ করে। মার মন যদি উন্নত হয়, তার কথা, এবং আলাপ জ্ঞানপূর্ণ হয়, শিশুর স্বভাব, চরিত্র এবং মনও বাল্যকাল হতে উন্নত ধরনের হতে থাকে। মা যদি বাচাল ও মূর্খ হন, ছেলেও ঠিক তেমনি হবে। মার মুখে ছেলে বড় বড় কথা শিখতে পারে, মার কাছে শিশু নীচতা ও মূর্খতার দান পায়। মা যদি যুক্তির সঙ্গে কথা বলেন, শিশুও যুক্তির সঙ্গে কথা বলতে শেখে। মা শিশুর কাছে একটা জীবন্ত জ্ঞান-ভাণ্ডার, যা পড়বার জন্যে শিশুকে ‘ক’ ‘খ’ শিখতে হয় না। কাগজের ক’ ও ‘খ’ না শিখেও শিশু উপযুক্ত মাতার সঙ্গ-শক্তিতে জ্ঞানে বড় হতে পারে।
পুরুষানুক্রমে মায়ের রুচি ও চরিত্র সন্তানের স্বভাবে প্রতিফলিত হয় বলে অশিক্ষিত লোকেও বংশ-গৌরব করে থাকে। অনেক সময় এই বংশ গৌরব মিথ্যা ভড়ংয়ে পরিণত। হয়, এও ঠিক।