পয়সা থাকতে কিছু সম্পত্তি কিনা উচিত–পল্লী টাউন যেখানেই হোক। দেশে মাটির মূল্যই বেশি। এ দেশ কৃষিপ্রধান। যার দু’বিঘা জমি আছে, তার ভাবনা নেই। জলে মাছ, মাঠে সোনা-বাঙালির নাই একটু ভাবনা। রাস্তা ঘাট ছাড়া বহির্জগতের সঙ্গে সম্বন্ধহীন নিতান্ত পল্লীগ্রামে বাস করলে আবার পরিবারের উন্নতি হয় না।
মাসে মাসে কিছু কিছু জমা করা চাই। স্বামীকে কিছু জমা করবার জন্যে পুনঃপুনঃ অনুরোধ করবে। পুরুষের অভ্যাস কেবল খরচ করে যাওয়া। সঞ্চয়ী হবার জন্যে স্বামীকে বিশেষ করে বলবে। স্বামী যদি কিছু না রাখেন তবে তার সঙ্গে ঝগড়া করাও ভালো। জমানো টাকা যেন কিছুতেই খরচ না করা হয়। নিজের নামে ডাকঘরে টাকা রাখলেও মন্দ হয় না–স্বামীর কাছ থেকে মাঝে মাঝে কিছু কিছু আদায় করে ডাকঘরে নিজের লোক দিয়ে জমা রাখবে।
হাতে পয়সা আছে বলেই অনবরত খরচ করতে নেই। সর্বদা কিছু কিছু জমাতে চেষ্টা করবে। তাই বলে নরপিশাচের মতো না খেয়ে, না পরে, টাকা জমানো ভালো নয়।
বিপদের দিনের জন্য কিছু কিছু টাকা রেখে দিতে হবে।
টাউনের পার্শ্বে যেখানে স্কুল ও শিক্ষিত সমাজ আছে, অথচ পল্লী, সেখানেই দরিদ্র পরিবারের বাসের উত্তম স্থান।
মেয়েমানুষের কিছু হুনর হেকমত শিখে রাখা নিতান্ত প্রয়োজন। স্বামী বিহনে যাতে একেবারে পথে না দাঁড়াতে হয় আগেই তার বন্দোবস্ত করতে হয়। ঘরে বসেই যাতে দু’পয়সা উপায় করা যায় তার জন্য ব্যবস্থা হওয়া চাই। নারীরা ঘরের মধ্যে বসে বই বাঁধাই, সোনা, রূপা, কাপড় ও কাঠের কাজ করতে পারেন। নারী না খেয়ে মরবে কেন? কত ইংরেজি মহিলা জামা-কাপড়ের কাজ করে কত টাকা উপায় করেন, তার খবর। আমাদের মেয়েরা কি রাখেন? কত নারী অভাবে দুঃখে পল্লীগ্রামের অন্ধকার ম্লান প্রদীপের। পাশে কাঁদছে! নারীরা দুঃখে কে কাঁদে? তারা যেন বিধাতার জীবন নয়! তাদের কথা চিন্তা করলে মানুষের পতন হতে পারে। তারা ধর্ম পথের কণ্টক। কী বিড়ম্বনা!
কুলসুম আবার বলিলেন–প্রিয় হালিমা, বাড়ির কর্তাকে ভাত দিলে, শুধু ভাত ডাল সামনে রেখে দিলেই বধূর কর্তব্য শেষ হয় না। আগে জায়গা ঠিক করতে হয়; ধুলা বালি থাকলে ঝেড়ে দিতে হয়, তারপর দস্তরখানা ও পানি দিয়ে ভাত দেবে।
রান্না হলেই স্বামী ও মুরুব্বীদের স্নান করে আসতে অনুরোধ করবে। সকলকে এক সঙ্গে ভাত দেবে। ভাতের জন্য কর্তাকে যেন দাঁড়িয়ে থাকতে না হয়। যদি বিশেষ দেরি থাকে, তাহলে মিষ্টি কথায় অপেক্ষা করতে বলবে।
বাড়িতে বেশি কেরোসিন তেল রাখবে না; দৈবাৎ যদি টিনে আগুন ধরে তাহলে সমূহ বিপদ হতে পারে।
নাইট্রিক এসিড, কার্বলিক এসিড বা কোনো বিষ জাতীয় ওষুধ খুব সাবধানে রাখবে। ইঁদুর মারবার জন্যে অনেকে ট্রিনিয় বিষ ব্যবহার করেন এরূপ করা নিষেধ।
বাড়িতে অনেক সময় গৃহিণীকে রাশি রাশি কাপড় সাফ করতে হয়। যার কাপড় সেই পরিষ্কার করলে একজনের মাথায় পাহাড় চাপে না।
পরিবারের সব কাপড় ধোপর বাড়িতে দেওয়া পল্লী-গৃহস্থের সাজে না। নিজেরাই মাড় ছাফ করলে কোনো ক্ষতি নাই। কাজের ক্ষতি না হলে এবং সময়ে কুলালে নিজেরাই অপরিষ্কার না থেকে ধুয়ে নেবে। ধোয়া কাপড় নীল লাগালে কাপড় শীগগীরই ময়লা হয় না। একটা ইস্ত্রি করবার যন্ত্র কিনে ঘরে রাখলে অনেক সময় নিজেরাই সার্ট-কোর্ট পলিশ করে নেওয়া যায়। ধোপারা কী প্রতিক্রিয়ায় কাপড় ধোয় এবং ইস্ত্রী করে তা ধোপার কাছে জিজ্ঞাসা করলেই সে বলে দেবে।
আজকাল এক রকম যন্ত্র বেরিয়েছে, দাম বেশি নয়, তাতে ৫/৬ মিনিটে নাকি ৬০/৭০ খানা কাপড় কাঁচা হয়, তা একটা কিনে পরীক্ষা করে দেখলে হয়।
বেশি বাসি খাদ্য কখনও ব্যবহার করতে নেই। এক দিনের বেশি মাছ জ্বালিয়ে খাবে না। সরু সাদা চাল ব্যবহার না করে লাল চাল ব্যবহার করা উচিত। সাদা চাল উপকারী নয়।
কৃপণতা করে বা বাজে খরচ করে কখনও খাওয়া-দাওয়ার ব্যয় কমাবে না। খারাপ খেলে শরীর টেকে না।
অবস্থা ভালো না হলে, কখনও লজ্জার খাতিরে, লোকে কি বলবে, এই ভেবে কোনো কিছু কিনো না, দরকার নেই অথচ অনুরোধে জিনিসপত্র কেনা মূর্খতা। যেমন অবস্থা তেমনি চলবে কারো পরোয়া করবার দরকার নাই।
বিক্রেতার মুখে জিনিস-পত্রের অন্যায় দাম শুনে রেগে ওঠা অভদ্রতা। বিক্রেতার মিষ্ট কথায় মুগ্ধ হয়ে অনুচিত মূল্যে কোনো কিছু কেনা বোকামি। বিক্রেতার ঠাট্টা উপহাস যতই কড়া হোক না, কানে তুলতে নেই। জিনিসপত্র এক দামে কিনতে চেষ্টা করা উচিত।
সোডা দিয়ে কাপড় না ধুলে বেশি টেকে। কলার পাতার ছাই উত্তম।
ঘর ঝাঁট দেবার সময় যেখানে সেখানে জুতো টান দিয়ে ফেলে। এরূপ করতে নিষেধ করবে।
কুলসুম বলিলেন-বোন, একটা অতি মূল্যবান কথা বলা হয় নি। পরিবারের কারো রোগ-ব্যামো হলে নারীরা সারারাত্রি জেগে কাটান, এটা নারী জীবনের শ্রেষ্ঠ গুণ। ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ যেই হোক, প্রাণ দিয়ে তাকে সেবা করবে রক্তের সঙ্গে বিশেষ সম্বন্ধ নেই বলে যে পীড়িতাকে অবহেলা করতে হবে এমন যেন কখনও না হয়। সেবা করবার লোক। যদি যথেষ্ট থাকে, তাহলে অনবরত একজনের রাত্রি জাগরণ ঠিক নয়। কিন্তু রাতে যদি দরকারই হয়, তবে তা জাগাতেই হবে। ছোট অন্য কাউকে জোর করে রোগীর পার্শ্বে বসিয়ে রাখা ঠিক নয়। অনেক মানুষ আছেন যারা নিজে নাক ডেকে ঘুমিয়ে, পরকে সারারাত্রি জেগে থাকতে বলেন, একটু ত্রুটি হলে গালাগালি দিয়ে নিজের হীনতার পরিচয় দেন। মানুষকে দেবার জন্যে দুঃখী রোগাক্লিষ্ট মানুষের সেবার জন্যে রাত জাগাতে যে কী আনন্দ হয়, তা কি এক মুখে বলা যায়?