ভাবি : অধিকার আছে। স্বামী ইচ্ছা না করলেও স্ত্রীর কর্তব্য স্বামীকে সুখ দেওয়া, সেবা করা। নারী জীবনের সাতকতাই এতে।
হালিমা : স্ত্রীর কি পাখার বাতাসের দরকার হয় না? তার নিজের গরম লাগলে তাকে কে বাতাস দেবে?
ভাবি : স্বভাবের এই অংশে নারী পুরুষ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ-নারীদের সব সম্পর্কেই স্নেহময়ী জননীর ভাব ফুটে উঠবে। স্বামী স্ত্রীর সেবা না চাইলেও স্ত্রী জোর করে স্বামীর সেবা করবে।
হালিমা : যাদ কেউ না করে? তা হলে তাকে হতোদর হতে হবে?
ভাবি : দেখ, সহানুভূতিই সব।-আমি তোমার জন্য কষ্ট করি, তুমিও আমার জন্য কষ্ট কর। স্বামী সুখ-দুঃখে, বিপদে-সম্পদে পত্নীর মঙ্গল চান, তার পরিশ্রমজাত দ্রব্যসম্ভার পত্নীকে বন্টন করে দেন, স্ত্রীর বিপদে প্রাণ পর্যন্ত দান করেন। অতএব স্ত্রীরও কর্তব্য এহেন বন্ধুকে সর্বদা সুখী করতে চেষ্টা করা। স্বামীকে নিজের শরীর ও আত্মার অংশ ভাবতে হবে। বিয়ের অর্থ–দুটি প্রাণীর একসঙ্গে বন্ধুরূপে বন্ধন। কে কাকে কতখানি সুখ দেবে তা অঙ্ক কষে হিসাব করে বলা যায় না।
হালিমা : ভাবি, আপনি বলছেন বিয়ের পর মাত্র বৎসর খানেক স্বামী স্ত্রীর জন্য মাদকতা অনুভব করেন।
কুলসুম : এই মাদকতাকে বিশ্বাস করতে হবে না। সদ্ব্যবহার দ্বারা স্বামীর শ্রদ্ধা লাভ করতে হবে।
হালিমা : ভাবি, ক্ষমা করুন; বলতে লজ্জা করে। আপনি আমার বন্ধু। আপনাকে আর লজ্জা কি? চাচির ছেলের জন্য আমার মনে অনুরাগের সঞ্চার হয়েছে। তার জন্য মনে মনে কষ্ট পাই। এই কথা বলিয়া হালিমা একটু হাসিল।
কুলসুমর না, না, এতে লজ্জা কি? যিনি স্বামী হবেন, তাঁর প্রতি অনুরাগের সঞ্চার হওয়া দোষের নয়।
হালিমা : স্বামীর প্রেম যেমন এক বৎসরেই শেষ হবে, আমার এই অনুরাগের আয়ুও কী এক বৎসর মাত্র।
কুলসুম : আশ্চর্য নয়।
হালিমা : তা ভাবতে আমার কষ্ট হচ্ছে।
কুলসুম : নারীর হৃদয়ের এই পরিবর্তনের কথা আর একদিন বলবো। আজ স্বামীকে কীভাবে সেবা করতে হয়, তাই শোন।
হালিমা : আচ্ছা বলুন।
কুলসুম : দেখ বিবাহিত জীবনে বাপের বাড়ির খামখেয়ালী সকলের আগে ত্যাগ করতে হবে। কোনো প্রকার উচ্ছল স্বভাব থাকবে না। পিতা-মাতা মেয়ের আবদার, জেদ সহ্য করেন, শ্বশুরবাড়ির কেউ তা সহ্য করে না; বরং তোমাকেই তাদের আবদার সহ্য করতে হবে। লোকে বউকে লালন পালন করবার জন্যে, তার আবদার উচ্ছৃঙ্খলতা সহ্য করবার জন্যে ঘরে নেয় না, বউই তাদের উচ্ছলতা সহ্য করবে এবং তাদেরকে পালন করবে। প্রথম কথা, খুব প্রাতঃকালে উঠবে।
হালিমা : রাত্রি তিনটার সময় কী?
কুলসুম : নামাজের ওয়াজের আধ ঘন্টা আগে। তিনটার সময় ওঠার কোনো দরকার নেই।
হালিমা : তার পর?
কুলসুম : স্নানের প্রয়োজন হরে গোসলখানায় যেয়ে গোসল করবে।
হালিমা : ভাবি, প্রাতঃকালে স্নান করতে যাওয়া বিড়ম্বনা। ছিঃছিঃ! সকলের সামনে সকাল বেলায় মাথায় পানি ঢালা কি লজ্জার কথা নয়?
কুলসুম : সবার সম্মুখে কেন? প্রত্যেক ঘরের পাশ্বেই একটা গোসল খানা থাকা চাই। ঘরের পেছনের চাল একধারে দৈর্ঘ্যে চার হাত, প্রস্থে চার হাত করে বাড়িয়ে গোসলখানা
করে নিতে হয়। এই স্থান শোবার স্থানের পাশেই হবে। প্রত্যেক মহিলার জন্য স্বতন্ত্র গোসলখানা থাকা উচিত। বাইরে স্নান করা কিছু অসভ্যতা। যে দিকে গোসলখানা সেদিকে চলাচলের পথ যেন না থাকে। এক বাড়িতে অনেকগুলি দম্পতি বাস না করলে সুবিধা হয়।
হালিমা : আচ্ছা, নারীকে পরের বাড়িতে সম্পূর্ণ অপরিচিত লোকের মধ্যে এসে বাস করতে হয় কেন? স্বামীর উপর তার দাবি আছে সুতরাং তারই সেবাসুখ চিন্তা করতে সে বাধ্য। অন্যের মন যুগিয়ে চলা কি কঠিন নয়? এতে কি মনের স্বাধীনতা এবং মনুষ্যত্ব নষ্ট হয় না?
কুলসুম : বিলাতে ছেলে বড় হলে বিয়ের পর তাকে স্বতন্ত্র স্থানে নূতন সংসার করে দেয়। আমাদের দেশে সে প্রথা নেই। ইংরেজের আচার-পদ্ধতি আমরা মানতে পারি না। স্বামীর কর্তব্য তাঁর মাতাপিতার সেবা করা, শান্তি ও সুখ দেয়া, ছোট ভাই বোনদের আবদার রক্ষা করা। স্বামী অর্থোপার্জনে বিদেশে যায় ও কম্যে ব্যস্ত থাকে; সুতরাং স্বামীর হয়ে স্ত্রীকে ঐ সমস্ত কর্তব্য করতে হয়। ইহাও একরকম স্বামীসেবা। কর্তব্যের নামে যে কাজ করা, তাকে স্বধীনতা এবং মনুষ্যত্ব নষ্ট হয় না। স্বামী স্ত্রীর ভরণপোষণ দিতে বাধ্য, সুতরাং স্বামীর বাড়িতে নিজেকে বাজে লোক মনে করবার কোনো কারণ নেই। স্বামীর কাছেও নিজের সম্মান ও দাবির মূল্য অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য কাবিনের ব্যবস্থা আছে। আমাদের সমাজে সাধারণত যত টাকার কাবিন হয়ে থাকে, তা অপেক্ষা বেশি টাকার কাবিন হওয়া উচিত; নইলে মেয়েদের মর্যাদা থাকে না। স্বামী বা শ্বশুর-শাশুড়ী যখন তখন বিপুল অসম্মানে বধুকে পথের ভিখারিনী করে দিতে পারেন। কাবিন অন্তত হাজার টাকার হবে। এই টাকা কখনও মাফ করতে নেই। কাবিনের পরিবর্তে কিছু জমি লিখে নেওয়াও মন্দ নয়, বরং তাই ভালো।
হালিমা : কিন্তু এতে স্বামীর স্বাধীনতা থাকে কি? স্বামীর সঙ্গে স্ত্রী যেরূপ ইচ্ছা সেইরূপ ব্যবহার করতে পারে, এমনকি নারী চরিত্রহীনা হলেও স্বামী কিছু বলতে পারে না!
কুলসুম : পুরুষ চরিত্রহীন হলে নারীর কি বলবার থাকে? স্বাধীনতা ও শক্তি হারিয়ে নারীর কারো সঙ্গে প্রেম করা অসম্ভব। এরূপে প্রেম হতেই পারে না। যে প্রতি মুহূর্তে নিজেকে স্বামীর কৃপার পাত্র মনে করে থাকে, সে কোনো প্রাণে স্বামীর প্রেমচুম্বন হাসিমুখে গ্রহণ করে? অসম্ভব! পুরুষ বহু স্থলে নারীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে থাকেন। নারী কবে কোথায় স্বামীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে? স্বামীর নিকট তার এমন কিছু আছে যা না পেলে তার জীবন মিথ্যা হয়ে যায়। নারীর কি ধর্ম ও বিবেক নেই?সে কি খোদাকে স্বীকার করে না? পুরুষ যে আবার বিয়ে করতে পারে।