হালিমা : বিয়ের সময় কবুল বলা কাজটা বড় ভয়ানক। ‘কবুল’ বলতে বল্লে বলতে হবে, না অনেক অনুরোধের পর ‘কবুল’ উচ্চারণ করতে হবে?
কুলসুম : অনেক মেয়ে কবুল করার সময় খুব ঝঞ্ঝাট বাধায়। কেউ হয়তো কথাই বলে না। ধীরভাবে প্রথমবারের অনুরোধেই কবুল উচ্চারণ করা উচিত। বিবাহ ব্যাপারটির মধ্যে লজ্জার কিছুই নাই। স্বামী গ্রহণ কাজটা অপমানজনক নয়, সুতরাং এতে লজ্জা বোধ করার কোনো কারণ নেই।
হালিমা : স্বামীর পার্শ্বে বসে পড়বো, তারপর?
কুলসুম : স্বামী যদি কোনো কথা জিজ্ঞাসা করেন, তবে খুব আদবের সঙ্গে উত্তর। দেবে। চুপ করে নির্বাক হয়ে থাকবে না।
হালিমা : আপনি করে বলবো, না তুমি করে বলবো?
কুলসুম : কেন? তুমি করে বলবে। স্বামী তো আর পীর সাহেব নন? হবে হুঁ হাঁ না বলে জি, জে ব্যবহার করবে। হুঁ, হাঁ বল্লেও বিশেষ দোষ নেই। আপনি করে বলে যেন পর করে দেওয়া হয়।
হালিমা : বাইরে অনেক মেয়ে বর-কন্যার কথা শোনার জন্যে উৎকর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন, এমন অবস্থায় কী করে কথা বলা যায়?
কুলসুম : যারা থাকতে পারেন তাঁরাই থাকেন। বর-কন্যার মিলন দেখে তারা তামাসা করে খুশি প্রকাশ করেন। অবশ্য কাজটি সরাহ বিরুদ্ধ।
হালিমা : স্বামী সাধারণত কী প্রশ্ন করেন?
কুলসুম : হয়তো নাম জিজ্ঞাসা করতে পারেন–কিংবা কী পড় তাই জিজ্ঞাসা করে থাকেন।
হালিমা : কন্যা কী বলবে?
কুলসুম : টপ করে করে নাম বলে ফেলবে। কী কী বই পড়েছ বলবে? পড়তে কেমন লাগে জিজ্ঞাসা করলে বলবে, খুব ভালো লাগে। যা পড়েছ তাই বলবে, বাড়িয়ে বলবে না। বন্ধুদের কথা জিজ্ঞাসা করলে বন্ধুদের নাম বলে দিতে হয়। স্বামীসঙ্গই ভালো লাগে, না বন্ধুদের কাছে থাকতে মন চায়–জিজ্ঞাসা করলে বলবে, স্বামীসঙ্গই ভালো লাগে। তোমার এত প্রশ্নের ভয় নাই। তোমার তো জানা লোক-লুকোচুরি করে যার সঙ্গে আগেই প্রেম। করেছ।
হালিমা হাসিয়া তাহার ভাবির চুলের খোঁপা ধরিয়ে কহিল-তাই বুঝি?
কুলসুম বলিলেন-তা না তো কি–আলাপ, হাসাহাসি কত কী?
হালিমা : ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে নাই নাকি? ওমা, আমি কোথায় যাবো? ছিঃ ছিঃ। হালিমা হাসিয়া হাসিয়া তাহার ভাবির গায়ের উপর শুইয়া পড়িল।
.
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
সবেবরাতের সন্ধ্যায় ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা পথে পটকা ফুটাইতেছিল, আর বাড়িতে বাড়িতে রুটি হালুয়া বিলাইয়া বেড়াইতেছিল, ইহা যে সরাহ-শরীয়ত বিরুদ্ধ তাহা তাহারা আদৌ চিন্তা করবার অবসর পায় নাই। আবদুণ গণি সেদিন বাড়ি আসিয়াছিল। সবেবরাত উপলক্ষে আবদুল গণি ভগ্নি হালিমার জন্য একখানি পুস্তক উপহার আনিয়াছে।
সন্ধ্যায় যখন চাচির আহ্বানে রুটি খাইতে আসিল, তখন পার্টির উপর বসিয়া প্রদীপ আলোকের সম্মুখে ঝকঝকে বইখানি রাখিয়া দিয়া কহিল-চাচি, হালিমার জন্য এনেছি।
চাচি জিজ্ঞাসা করিলেন–কী উপহার বাবা? বইয়ের দিকে চাহিয়া আবদুল গণি কহিল-এই বইখানি।
বেশ বাবা বলিয়া চাচি হালিমাকে ডাক দিয়া বারান্দায় যাইয়া দাঁড়াইলেন। অল্প অন্ধকারে হালিমা, মায়ের বুকের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। মা কন্যার হাতে বইখানি দিয়া কহিলেন–তোমার ভাই তোমার জন্য উপহার এনেছে।
মেয়েকে বইখানি দিয়া চাচি ফিরিয়া আসিয়া আবদুল গণির পার্শ্বে বসিয়া কহিলেন–কদিন বাড়ি আছ বাবা?
আ-গণি। বেশি নয়, দু’দিন থাকবো। নিজের কাজ নিজে না দেখলে ক্ষতি হয়, তাই কোথাও ক’দিন কাটাতে পারি নে। বাড়িতে না এলেও চলে না, ব্যবসা-বাণিজ্য তদারকও হয় না।
চাচি : টাউনে নূতন বাড়িটি কি শেষ হয়েছে?
আ-গণি। হয়েছে। পনের দিন পরে আপনাদের জন্য নৌকা পাঠিয়ে দেবো। সকলেই যাবেন। মা, আপনি, হালিমা, আর ভাবি।
চাচি : বেশি দিন তো থাকতে পারবো না।
ততক্ষণে আবদুল গণির খাওয়া হইয়াছিল। সে নূতন কলসী হইতে পানি ঢালিয়া লইতে অগ্রসর হইল, চাচি তাহার হাত গ্লাস লইয়া পানি ঢালিতে ঢালিতে কহিলেন–ওমা, পানি নাই, গ্লাসে।
আবদুল গণি বাহিরে হাত ধুইতে ধুইতে কহিলেন–একটু পরিবর্তন চাই, নইলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে না।
চাচি : তাতো ঠিক।
এমন সময় ভাবি সাহেবা আসিয়া আবদুল গণির কুশল জিজ্ঞাসা করিলেন। গণি উঠিয়া শ্রদ্ধা জানাইল। ভাবি সাহেবা-দেবরকে বসিতে বলিয়া কহিলেন-তা ভাই, কবে আমাদের টাউনে যাওয়া হচ্ছে?
আ-গণি। আপনাদের যে দিন মরজি হয়।
ভাবি : হালিমা বিবি বলছেন মঙ্গলবারে। হালিমা বাহির হইতে সহসা ক্রোধে একবার ভাবির দিকে তাকাইল।
হালিমার মা কাহলেন–না এই মঙ্গলবারে নয়, যে মঙ্গলবার আসছে, এর পরের মঙ্গলবারে।
হালিমার ভাবি কাহিলেন–আচ্ছা মা, তাই হোক না?
.
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
নীরব সন্ধ্যায় ছাদের উপর বসিয়া হালিমা তাহার ভাবিকে জিজ্ঞাসা করিল–ভাবি, স্বামী। সেবার অর্থ কী?
ভাবি : স্বামীকে সুখ দেওয়া।
হালিমা : কেমন করে?
ভাবি : এই যেমন স্বামীকে পাখা করা, তামাক খাবার অভ্যাস থাকলে তামাকে সাজিয়ে দেওয়া, গায়ে মাথায় হাত বুলান, সামনে বসিয়ে খাবার খাওয়ান ইত্যাদি।
হালিমা : স্ত্রী কি স্বামীর চাকর?
ভাবি : কেন? এসব কি চাকরের কাজ? বন্ধু কি বন্ধুকে সেবা করে না–বন্ধুকে সুখ দিয়ে আনন্দ পায় না? মা সন্তানকে পালন করেন সেকি দাসীরূপে?
হালিমা : স্ত্রীর নিকট হইতে স্বামীর এই সেবা দাবি করবার কি অধিকার আছে?