হালিমা : পরিবারে যখন কাজের সাড়া পড়ে যায়, তখন স্বামীর কীরূপ ব্যবহার করতে হবে?
কুলসুম : বিবাহের অব্যবহিত পরে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মনই উদ্দাম আবেগপূর্ণ হয়ে ওঠে। স্ত্রীর ইচ্ছা হয়, সব সময় স্বামীর সঙ্গে গল্প করেন। ঘরের মধ্যে স্বামীর সঙ্গে হাসাহাসি ও আলাপ করেন। একটু পুরোনো হল অর্থাৎ বিয়ের দু-এক বছর পর, এ আবেগ। থাকে না। এরূপ দেখে অনেক অনুন্নত-হৃদয় ব্যক্তি বিরক্ত হন। যুবক-যুবতীর পবিত্র মধুর প্রেমের প্রতি এদের মোটেই সহানুভূতি নেই। ইংরাজেরা বিয়ের পরে মানুষের কুদৃষ্টি হতে ছেলেমেয়েকে ২/১ মাসের জন্য দূরে পাঠিয়ে দেন। মনের আবেগ কমলে যুবক-যুবতী বাড়ি ফিরে আসেন–এ প্রথাটা মন্দ নয়। যা তুমি বলছিলে–প্রাতঃকালে যখন সংসারের কাজকর্মের সাড়া পড়ে যায়–গাছপালা যখন স্বর্ণ রৌদ্রে অভিসিক্ত হয়ে ওঠে তখন স্বামীর কাছে বসে হাসাহাসি গল্প করতে নেই, তাতে দুষ্ট লোকের মন একটা ঈর্ষা এবং অপবিত্রভাবে পূর্ণ হয়। এইরূপ করলে কোনো দোষ হয়, এ আমি বলি না! উন্নত ও শিক্ষিত পরিবারে এরূপ করা দোষের বলে মনে করে না। আবার কাজ নষ্ট করে স্বামীর সঙ্গে গল্প কারও ঠিক নয়। যদি এই সময়ের মধ্যে মানুষের অগোচরে স্বামীর সঙ্গে দেখা হয় তা হলে স্বামীকে একটা মমতার কটাক্ষ, একটু ওষ্ঠের মৃদু হাসি দেখাতে ছাড়বে না। স্বামীর সঙ্গে দেখা হলে জীবনের কোনো সময় গম্ভীর হয়ে থাকবে না। লোক থাকলে স্বামীর সামনে গম্ভীর হয়ে থাকা ভালো। গৃহে যদি স্বামী ছাড়া আর কেউ না থাকে, তবে সঙ্কোচ বোধ করাবার দরকার নেই।
হালিমা : দুপুরবেলা স্বামী এলে তার গায়ে বাতাস দিতে হবে নাকি?
কুলসুম : দুপুরবেলা ঘুমানো অন্যায়; বাতাস দিয়ে ঘুম আনা কাজেই তত ভালো কাজ নয়। স্বামীর যদি একই ঘুমাবার অভ্যাস হয়ে থাকে, তবে একটু আধটু বাতাস দিতে পার। বাতাস দিতে নিজের ক্লান্তি বোধ হলে বাড়িতে ছোট চাকর-বাকর থাকলে তাকে বাতাস দিতে বলবে। আর বাতাস তারই দেওয়া ভালো-স্ত্রী বা অন্য কোনো নিকট আত্মীয় ছাড়া অন্য কারো দ্বারা বাতাস খাওয়া বা জুতা খোলা বর্বরতার লক্ষণ। কোনো মেয়ে চাকরাণীকে কখনও স্বামীকে বাতাস দিতে বলবে না। দুপুরবেলা কখনও স্বামীর কাছে শোবে না, এতে স্বামীর শরীর খারাপ হতে পারে। কথা বললে, গল্প করলে কোনো দোষ নেই। শ্বশুর-শ্বাশুড়ী যদি বিরক্ত হন তবে তাঁদের সামনে বা তারা শুনতে পান, এমন স্থানে স্বামীর সঙ্গে কথা বলবে না। স্বামী যদি বাহির হতে পরিশ্রম করে আসেন তবে তাড়াতাড়ি পাখা নিয়ে তাঁকে বাতাস করলে মমতার পরিচয় দেওয়া হয়–এতে মোটেই লজ্জা করবে na। স্বামীর সেবায় অপমান নেই। বাড়িতে যদি একখানা ছোট চালানো পাখা তৈরি করে নেওয়া যায়, তবে বড়ই ভালো হয়। পরিশ্রান্ত হয়ে তার নিচে একখানা আসন নিয়ে বসে কাউকে দু’মিনিটের জন্য পাখা টানতে বললে সকল ক্লান্তি দূর হয়। স্ত্রীও কাজ করতে পারেন। এই টানা-পাখা তৈরি করতে বিশেষ খরচ হয় না। গ্রীষ্মকালে শোবার ঘরেও এরূপ পাখা ব্যবহার করা যায়। প্রাচীর বা বেড়ার ভেতরে দিয়ে পাখার দড়ি বের করে দিতে হয়। বাইরে হতে ঘুম আসা পর্যন্ত বা আধঘণ্টা মতো চাকর বসে বসে পাখার দড়ি টানতে পরে। আর শহরে যাদের বৈদ্যুতিক পাখা আছে তাদের এইসব ঝামেলার কোনো বালাই নেই।
হালিমা : মাঝে মাঝে স্বামীকে পান সেজে দেওয়া কেমন?
কুলসুম : পান-তামাক খাওয়া অনেক স্বামীর অভ্যাস নেই। স্বামীর পান-তামাক খাওয়ার অভ্যাস থাকলে, প্রয়োজন আছে কিনা নিজেই জিজ্ঞাসা করবে। কোনো কোনো সময় জিজ্ঞাসা না করেই তার কাছে পান-তামাক নিয়ে উপস্থিত হবে। নাস্তা থাকলে স্বামীকে যেন তা জিজ্ঞাসা করে, খুঁজে না নিতে হয়। খাবার জন্য স্বামীকে সময় সময় অনুরোধ করবে। খেতে দাও, নাস্তা খেতে দাও এরূপভাবে চেয়ে যেন স্বামীকে না খেতে হয়। স্বামী যখন ইচ্ছা তখন খাবে–এতএব স্ত্রীর উদ্যোগের কোনো কারণ নেই, এরূপ ব্যবহার অন্যায়। বেলা হয়ে গেলে স্বামীকে খাবার জন্য অনুরোধ করবে। ভালো জিনিসপত্র স্বামীকে খেতে দিতে যেন কখনও ভুল না হয়। পরী যেমন স্বামীর সুখের ব্যবস্থা করতে সদা ব্যস্ত থাকবেন, স্বামীও যেন তেমনি স্ত্রী সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যতার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখেন।
হালিমা : নারীর কর্তব্যই আমি বেশি করে শুনতে চাই। স্বামীর কর্তব্য স্বামীই পালন করবেন।
কুলসুম : স্বামীর কাপড়-চোপড়, গামছা, জুতা গুছিয়ে আলাদা করে রাখা ভালো। অনেক সময় জিনিসপত্র খুঁজে বের করা যায় না–কাজের বড় ক্ষতি হয়, বিরক্তও কম হয় না।
স্বামীকে পানি দিতে হলে সব সময় গ্লাস মেজে দেবে। পানি দেওয়ার সময় দেখে নিও গ্লাসের ভিতর ময়লা পড়ছে কিনা। চাকরানীরা ঘাট থেকে যে পানি তুলে আনে তা স্বামীকে দিতে নেই। স্বামী বলে নয়, চাকরানীর তোলা পানি খাওয়ার জন্য ব্যবহার না করাই ভালো। পরিবারের প্রতি যিনি মায়া পোষণ করেন তারই হাতে খাবার পানি ঠিক রাখবার ভার দেওয়া উচিত। তাঁরই রান্না করা উচিত। এ সমস্ত কথায় মনে করো না, দাসীদের হুঁতমার্গ সেবাকারী হিন্দুদের মতো দূর দূর করতে হবে! বস্তুত খাবার পান ও রান্নার উপর নিজের বিশেষ দৃষ্টি থাকা চাই।