কুলসুম : মেয়ের হাতখানি জামাই এবং জামাই এর বাপের হাতে তুলে দেওয়ার কথা? এ একটা জঘন্য ব্যাপার। এতে যেন কত অপরাধী তাই দেখান হয়। মেয়ের যদি কোনো গুণ থাকে, তাহলে তার শ্বশুরবাড়ি যেয়ে অসম্মান হবে না। যেখানে মেয়েকে খোশামোদ করে বিয়ে দেওয়া হয়, সেখানে বিয়ে না দেওয়াই উচিত। মেয়ের ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র অপরাধ স্বামী শ্বশুরের আদৌ লক্ষ করা উচিত নয়। তাদের নিজেদের অনেক ভুল আছে। সকলেরই ভুল হয়। কারো চরিত্রের যদি বিশেষ ভুল থাকে, তা হলে সেটা সম্ভবত মেনে নেওয়া উচিত। বধূ যদি শিক্ষিত ও বিত্তশালিনী হন, তা হলে তার উপর কারো প্রভুত্ব ও সমালোচনা বিশেষ চলে না। কাজের অনবরত বিরক্তিকর সমালোচনা হতে থাকলে মানুষের মনুষ্যত্ব নষ্ট হয়।
হালিমা : বিয়ের সময় পাত্রী ও বর নিয়ে অনেক কেলেঙ্কারি হয়! এমন হবার কারণ কী?
কুলসুম : এর জন্য পাত্রপক্ষ এবং পাত্রীপক্ষ উভয়েই দোষী। বিয়ের আগে সকল বিষয় ঠিক করে নিলে আর সেই কেলেঙ্কারী হয় না। পূর্বে সকল কথা ভালো করে মীমাংসা করে নিতে লজ্জা করলে চলবে না। কত টাকার কাবিন হবে, কি গয়না বা কি কি জিনিস লাগবে, আগেই ভালো করে পরিষ্কার করে নিতে হবে। কাবিনের টাকা অনেক সময় আদায় হয় না, স্বামীর পিতা অর্থাৎ শ্বশুরের কর্তব্য বধূকে কিছু জমি দেয়া। বস্তুত টাকার কাবিন হয়ে যদি জমির কাবিন দেওয়া যায়, তাই ভালো। এতে স্বামীর বা স্বামীর পিতার কিছুমাত্র সঙ্কোচ বোধ করা উচিত নয়। একটি কুলকন্যা কোন সাহসে বাপের সঙ্গে সকল সম্বন্ধ কেটে ফেলে পরের বাড়িতে আশ্রয় নেবে। সে সম্বন্ধে সকলেরই বিবেচনা করা উচিত। গয়না-পত্র সম্বন্ধে বিয়ের মজলিসে অনেক সময় কলহ-বিবাদ হয়। গয়নার জন্যে পাত্রী পক্ষই বেশি কলহ করেন। এ বড় অন্যায়। মেয়ে যার পত্নী হবে, সে যদি স্ত্রীকে গাছের বাকল পরিয়ে সুখী হয়, তাতে পাত্রীপক্ষের কোনো আপত্তি থাকা উচিত নয়। মেয়ে কি চায়?-স্বামীর শ্রদ্ধা ও অনুরাগ। বিবাহের দিন স্বামী যদি স্ত্রীকে মলিন বেশে ঘরে নিয়ে যেতে চান, তাতে অপরের কি ক্ষতি? এক সময়ে অনেক টাকা একসঙ্গে জমা করা অনেকের পক্ষে কঠিন। স্ত্রীর কর্তব্য নয় গয়না, কাপড়ের জন্য স্বামীকে ঋণজালে জাড়িত করা। গয়নার টাকা বা বাজে খরচ যোগাড় করতে না পারলে কি লোকে অবিবাহিত থাকবে? বলতে পরো, কেউ যদি টাকা জমা করতে না পারে, সে কি গুণহীন কন্যাকে বিয়ে করবে? আমি বলি ভদ্রলোকেরাই বেশি করে। যারা গরিব তাদের একসঙ্গে অনেক টাকা জমা করা কঠিন। সব ভদ্রলোকেরাই যে গরিব হবে এ আমি বলছি না।
হালিমা : কিন্তু খালি হাতে পুরুষের উচিত নয় বিয়ে করা। বিবাহের দিন স্বামীর . কর্তব্য স্ত্রীকে উপহার অর্থাৎ গয়না কাপড় যৌতুক দেয়া।
কুলসুম : নিশ্চয়ই কর্তব্য। স্ত্রীর মনে বিশ্বাস হওয়া চাই স্বামী তাকে ভালবাসবে। উপহার ছাড়া শুষ্ক মৌখিক ভালবাসার মূল্য নেই। বংশের সম্মানের জন্য অনেকে জামাই পক্ষ হতে নগদ টাকা চায়; এরূপ লোকের কন্যাকে ঘৃণার সঙ্গে যাদি লোকে প্রত্যাখ্যান করেন তবে তাতে রাগ করা কঠিন।
হালিমা : বিবাহের অযথা খরচের অর্থ কী?
কুলসুম : এই যেমন পান, তামাক, মিঠাই এবং অযথা কতকগুলি বরযাত্রী সমাগমে বিস্তর খরচ হয়। বিবাহের সময় কয়েকজন নিকট আত্মীয় ছাড়া বেশি বরযাত্রী সমাগম ভালো নয়। অনেকগুলি লোক একসঙ্গে এক সন্ধ্যায় কোনো জায়গায় গেলে গৃহস্থের অনেক টাকা খরচ হয়। এমনিভাবে টাকা বরবাদ না করে কোনো সৎ উদ্দেশ্যে যদি সেগুলি দান করা হয় তবে সমাজের বড়ই উপকার হবে।
হালিমা : সে কথা ঠিক। অনেক সময় বরযাত্রীদের প্রতি বড় অসম্মান দেখান হয়।
কুলসুম : নিকট আত্মীয় না হলে বরযাত্রী হওয়া ঠিক নয়।
হালিমা : বিয়ে মেয়ে বাড়িতে হওয়া উচিত না অন্য কোনো স্থানে হওয়া ভালো? বিয়ের পূর্ব পর্যন্ত বরপক্ষ যখন সম্পূর্ণ অজানা লোক তখন তারা কি বলে মেয়ের বাড়িতে উপস্থিত হবে?
কুলসুম : খুব ভালো কথা বলেছ বোন। বিয়ে মেয়ের বাড়িতে হওয়া আদৌ ঠিক নয়। দূর দেশে অজানা অচেনা স্থানে উপস্থিত হয়ে অনেক সময় বরপক্ষকে যারপরনাই বিপন্ন হতে হয়। বিয়ে কোনো মসজিদে হওয়া ভালো। সেখানে কারো ব্যক্তিগত প্রাধান্য নেই। মেয়েকে সাজিয়ে মসজিদে উপস্থিত করার দরকর নেই। মেয়ের প্রতিনিধিরা মেয়ের হয়ে সব কাজ করতে পারেন।
হালিমা : রাত্রিতে বিয়ের প্রকৃষ্ট সময় নয় কি?
কুলসুম : রাত্রিতে বিয়ে না হওয়া উচিত–এতে রত্রি জাগরণ ভয়ঙ্কর অনিয়ম, ফলে স্বাস্থ্যনাশ ঘটে।
হালিমা : বিয়ে দূরদেশি হওয়াই উচিত, না খুব কাছে হওয়া ভালো?
কুলসুম : বিয়ে দূরদেশে না হওয়াই ভালো।
হালিমা : যদি ভালো বর না পাওয়া যায়।
কুলসুম : তবে অগত্যা দূরদেশেই যেতে হবে। একদল নতুন লোক যাদের রুচি ও সভ্যতা অন্য রকমের-তাদের মধ্যে পড়লে মেয়ের খুব কষ্ট হয় বলে মনে হয়, মেয়ে যেন বনবাসিনী হয়ে পড়ে। মেয়ের মত নিয়ে কাজ করলেও মন্দ হয় না। যাতায়াতের সুবিধা থাকলে দূরে বিয়ে হতে পারে। এতে সন্তান-সন্ততির দৃষ্টি ও মন উদার হয়। আবার কতগুলি লোক আছে, যারা নিজেদের আওতাধীন স্থানকেই পৃথিবী মনে করে।